জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছেই
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি লাগামছাড়া
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৪, ০৮:৩১ রাত

দেশের মানুষ এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চাপ তীব্রভাবে অনুভব করছে। গত বছরের আগস্ট থেকে এই চাপ শুরু। এই সময়ের মধ্যে কোনো মাসেই মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে নামেনি। এক বছর ধরে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। এর মানে হলো, দেশের মানুষকে এক বছর ধরে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। এটি সরকারি হিসাব। তবে গরিব মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চাপ আরও বেশি।
মূল্যস্ফীতি হঠাৎ করে পরের মাসেই ব্যাপক হারে কমে যাবে, তা আশা করা যায় না। সাধারণত উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা, আয় বৃদ্ধি - এসবের ওপর ভিত্তি করেই মূল্যস্ফীতি কমে। তাই শিগগিরই মূল্যস্ফীতি ৪-৫ শতাংশে নেমে যাওয়ার কথা নয়। দ্রব্যমূল্য দিন দিন মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি এখন এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে, মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে পরিণত হচ্ছে আর নিম্নবিত্ত মহাসংকটে পড়ছে। মানুষ এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। যাদের সঞ্চয় নেই, তারা ঋণ করছেন। ফলে মানুষের ওপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দিন দিন সংকট আরও বেড়ে যাবে। বাজেট প্রস্তাবে সরকার মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে ধরে রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, এটি কাল্পনিক ও অবাস্তব বলে মনে করছেন দেশের তারা। তারা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকার যে কৌশল নিয়েছে; তা বরং মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি করতে পারে। এটি সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার বেশ চড়া।
এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, আমাদের দেশটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এখানে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে; গরিব আরও গরিব হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রতিদিনকার জীবনযাত্রায় সৃষ্টি করেছে এক টালমাটাল অবস্থা। আয়-ব্যয়ের সংযোগ ধরে রাখতে না পেরে অনেকেই ভুগছেন অশান্তিতে। অস্থিরতা আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয়। মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণও এখন বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যেও।
মানুষকে পণ্য কিনছে হচ্ছে ৯ শতাংশের বেশি দামে। গরিবের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চাপ আরও
দেশে ৮৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী নিত্যকার জীবনের বেশিরভাগ মানসিক চাপের উৎসই হচ্ছে সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতি। এই মানসিক চাপ থেকে মুক্তি না পেলে দৈনন্দিন জীবন ক্রমেই হয়ে উঠবে আরও দুর্বিষহ।
বিবিএসের তথ্য বলেছে, সর্বশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৮৬ শতাংশ। এর পরেই নভেম্বর মাসে এক লাফে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৮.৮৫ শতাংশে আসে। ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয় ৮.৭১ শতাংশ। চলতি বছরের শুরু থেকে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ শতাংশের উপর। জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি হয় ৮.৫৭ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮.৭৮ শতাংশ। মার্চে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘর পেরিয়ে দাঁড়াবে ৯.৩৩ শতাংশ। সর্বশেষ এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি দাঁড়াতে পারে ৯.২৪ শতাংশে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিডিপি) বলেছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রত্যাশা; তা পূরণে ব্যর্থ এ বাজেট। তারা বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি; মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও বিনিয়োগ সূচকের ক্ষেত্রে যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে, এর সঙ্গে বাস্তবতার তেমন মিল নেই। দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায় বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাগুলো বেশ উচ্চাকাক্সক্ষী। বাস্তবতা স্বীকার না করে এ ধরনের অনুমিতি বা প্রক্ষেপণের দুর্বলতার কারণে পরে বাজেট বাস্তবায়ন হোঁচট খাবে। এতে শেষ পর্যন্ত হয়তো এসব লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নও হবে না। সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে টাকা ছাপাতে পারে; বরং তা হিতে বিপরীত হতে পারে। নতুন টাকা ছাপা হলে তা টাকার মূল্যমানকে আরও কমাবে এবং মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, আমাদের আয় তো বাড়ছে না। কিন্তু ব্যয় তো বেড়েই চলেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আমাদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এখন আমাদের ঋণ নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে ঋণ নিলে তা শোধ করতেই হয়। আমাদের দেশে তো বেকার ভাতা নেই। আমাদের স্বাস্থ্য খাতে একটা বড় খরচ চলে যায়। অথচ উন্নত দেশগুলোয় দ্রব্যমূল্য বাড়লেও স্বাভাবিক জীবনে এর খুব বেশি প্রভাব পড়ে না। কারণ স্বাস্থ্য খাতে তাদের খরচ করতে হয় না।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশে এখন অনেক সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। তরুণরা বিপথগামী হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। কারণ তারা হাত পাততে পারেন না। ফলে তাদের সঞ্চয় ভেঙে বা ঋণ করে চলতে হচ্ছে তাদের। আর ওই ঋণ শোধ করতে গিয়েই হচ্ছে সংকট। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় সরবরাহ, উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানিসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিঘ্নিত হলে সংকট আরও বাড়বে।
এমসিসিআই সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা জীবনযাত্রায় যেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে; তেমনি ব্যবসায় মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। শিল্পের কাঁচামাল সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না। রপ্তানি পণ্য সরবরাহ দুরূহ হয়ে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। এর পাশাপাশি বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় স্থানীয় বাজারে পণ্যের চাহিদাও অনেক কমে গেছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য বিঘ্নিত হচ্ছে।
তিনি জানান, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির প্রভাবে দেশে মূল্যস্ফীতি এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আবার পণ্য আমদানিতে এখন প্রতি ডলারে ১২৪ টাকা ব্যয় হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে পণ্যের দামে এবং শেষ পর্যন্ত ভোক্তার কাঁধে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ছে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। রাজনৈতিক অস্থিরতায় পরিবহন ব্যয় বাড়লে পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে।
দৈনিক সরোবর/কেএমএএ