ঢাকা, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩১

টানা তাপপ্রবাহে পুড়েছে ফসল

সরোবর ডেস্ক 

 প্রকাশিত: মে ০৬, ২০২৪, ০৭:৩৬ বিকাল  

দেশজুড়ে টানা প্রায় মাসব্যাপী বয়ে চলা মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিছু এলাকার বোরো ধানসহ বিভিন্ন ফসলের। ফেটে চৌচির পাটক্ষেত। ব্যাপক হারে ঝরছে আম-লিচুর গুটি। সিজনাল সবজি উৎপাদনেও পড়েছে প্রভাব। গরু, ছাগল, মুরগিসহ প্রাণিকুলেও ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পোল্ট্রিশিল্প। ওজন কমে লোকসানের হুমকিতে গরু-ছাগলের খামারিরা। আর  তাপপ্রবাহের শুরু থেকে হিটশকের ঝুঁকিতে ছিল বোরো ধান।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) সূত্র জানায়, এবার সারাদেশে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ৫০ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে, যেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দুই কোটি ২২ লাখ টন। গত কয়েক সপ্তাহের তীব্র তাপপ্রবাহে সারাদেশে প্রায় ১০ লাখ টন ধান কম উৎপাদনের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলে ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ওইসব এলাকায় এখন পর্যন্ত তিন থেকে চার শতাংশ জমির ধান চিটা হয়ে গেছে। কম ক্ষতি হয়েছে হাওরে।

সংস্থাটির উদ্ভিদ শরীরতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজ্জাদুর রহমান বলেন, গড়ে সারাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় তিন শতাংশ ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাপপ্রবাহ চলতে থাকলে ক্ষতি আরো বাড়তে পারে। হাওরাঞ্চল ছাড়া সারাদেশে এখন ফ্লাওয়ারিং স্টেজ চলছিল, যা ধানের জন্য খুব নাজুক অবস্থা। পরাগায়নের সময়কাল ঠিকমতো হচ্ছে না। কারণ সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে স্বাভাবিক পরাগায়ন হয়, তখন তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির ওপর চলে গেছে। এ কারণে এপ্রিলের শুরুর দিক থেকে মাঝ এপ্রিল পর্যন্ত যেসব এলাকার ধানে ফ্লাওয়ারিং হয়েছে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাঝ এপ্রিলের পরে গত সপ্তাহ পর্যন্ত যেসব এলাকায় ধানে ফ্লাওয়ারিং হয়েছে, যেমন উত্তরাঞ্চল। সেখানে ৪ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন কমবে। সার্বিক উৎপাদনের ৩০-৩৫ শতাংশ হয় উত্তরের ওইসব জেলায়।

ব্রি এমন শঙ্কা করলেও ক্ষতির পরিমাণের চূড়ান্ত কোনো হিসাব এখনো করেনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। কৃষিতে ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব এখনো তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি বলেন, কিছুটা ক্ষতি হলেও ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি হবে না। আমি আজ ভাঙ্গা, ফরিদপুর, বরিশাল এলাকায় সারাদিন দেখলাম। খুব সমস্যা দেখছি না। শুধু সেচ বেশি লাগছে। সেজন্য চাষিদের খরচ বেশি হচ্ছে। হাওরে ৮০ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। উত্তরাঞ্চলের ক্ষতির বিষয়ে বলা হলে তিনি বলেন, তাপ হলেও চাষিরা ক্ষেতে পানি দিচ্ছে। মনে হয় অসুবিধা হবে না। তারপরেও সারাদেশে নির্দেশ দিয়েছি ক্ষতির প্রতিবেদন দিতে। তখন জানাতে পারবো।

নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার পাড়িচা গ্রামের কৃষক রইছ উদ্দিন। সরিষার পরে দেরিতে বোরো লাগিয়েছিলেন। প্রচণ্ড খরতাপে তার ধানগুলো পুড়ে যাচ্ছে। সেচ দিয়েও পানি রাখতে পারছেন না, ঘন ঘন ক্ষেত শুকিয়ে যাচ্ছে। বারবার সেচও পাচ্ছেন না লোডশেডিংয়ের কারণে। তিনি বলেন, জমিতে পানি রাখতে পারলে কিছুটা হলেও ফসল রক্ষা হতো। কিন্তু হচ্ছে না, খরচ বাড়ছে। গরমে শ্রমিক নদী থেকেও সেচ দিতে চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এসব ধান চিটা হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলা সদরের কৃষক সালাম মিয়া বলেন, রোদে পুড়ে ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে। মাঠে এত পানি দিয়েও রাখা যাচ্ছে না। পানিও পাওয়া যাচ্ছে না। এবার ফলন খুব কম হবে বোঝা যাচ্ছে। খুব চিন্তায় আছি। ফেটে চৌচির পাটক্ষেত: জানা যায়, সারাদেশে পাট গাছ রোদের কারণে নুয়ে পড়ছে। পাট গাছের বৃদ্ধি কমে গেছে। চাষিরা জানান, অতিরিক্ত খরায় ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির। সকালে পানি দিলে বিকেলের আগেই শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির অভাবে পাট বেড়ে উঠছে না। শ্যালো মেশিনেও উঠছে না পানি। তাপপ্রবাহ বেশি হওয়ায় বিগত সময়ের তুলনায় জমিতে সেচ লাগছে বেশি। যে কারণে এবার ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন চাষিরা।

পাটচাষি নুরুল ইসলাম বলেন, এবার পাট নিয়ে খুব সমস্যায় পড়েছি। সার, বীজ, কীটনাশকসহ সব কৃষিপণ্য বেশি দামে কিনে চাষ করা পাট ভালো হচ্ছে না। অতিরিক্ত খরায় ক্ষেত শুকিয়ে পাট বেড়ে উঠছে না। রাজবাড়ির চাষি আব্দুল মান্নান বলেন, আগে এসময় যেখানে দুবার সেচ দিতে হতো, এবার সেখানে চার-পাঁচবার পানি দিয়েও কূল পাচ্ছি না। সকালে পানি দিলেই বিকেলে শুকিয়ে যাচ্ছে। ক্ষেত ভেজাতে সময় ও খরচ দুটিই বেশি লাগছে।

তাপে ঝরছে আম-লিচু, ফলনে ধস: অতিমাত্রার খরতাপে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, মেহেরপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের আম-লিচুর গুটি ঝরে পড়ছে। এভাবে গুটি ঝরে পড়তে থাকলে বাগান মালিকরা মোটা অঙ্কের লোকসানে পড়বেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাগান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বাগান মালিক ও ইজারাদাররা।

চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর জেলায় লক্ষ্য করা গেছে। ৪০ ডিগ্রি থেকে ৪২ ডিগ্রির উপরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। প্রাকৃতিকভাবেই চলতি মৌসুমে আম-লিচুর মুকুল বেরিয়েছে ৬৫ শতাংশ। বাকিটায় নতুন পাতা বের হয়েছে। 

অন্যদিকে বর্তমানে আম-লিচুর জন্য প্রতিকূল আবহাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে এবার আম-লিচুর ফলন কিছুটা কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় লিচুর বাগান ৮০০ হেক্টর জমিতে। এসব বাগানে আটি লিচু, বোম্বাই, চিলি বোম্বাই, আতা বোম্বাই ও চায়না-থ্রি জাতের লিচু হয়। চলতি বছর জেলায় সাড়ে ৮ হাজার টন লিচুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আমের বাগান আছে ৩ হাজার ৩৩৬ হেক্টর। ঈশ্বরদীর সলিমপুর ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাইফুদ্দিন ইয়াহিয়া বলেন, মোজাফ্ফর জাতের দেশি লিচু বেশি তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে না। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় এটি পুড়ে কালচে হয়ে যায়। শুধু গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত সেচ ও গাছের ওপরে পানি ছিটানোর মাধ্যমে এটি কিছুটা রোধ করা যেতে পারে। এছাড়া লিচুর কালচে রং রোধ করতে চাষিরা ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে পারে।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার বলেন, বৃষ্টি না হলে লিচুর গুটির চামড়া পুড়ে যাবে। চলতি মৌসুমে ঈশ্বরদীতে কোনো বৃষ্টি হয়নি। এজন্য গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ চালু রাখতে হবে। সম্ভব হলে গাছের ওপর পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। একই সঙ্গে লিচু পাকার মৌসুমে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির বেশি হলেই লিচু শুকিয়ে ঝরে পড়তে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত অন্য ফসলও: টানা খরায় পুড়ছে নীলফামারীসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় বিবর্ণ হচ্ছে ক্ষেত-খামারের ফসল। জমির ধান, বাদাম, মরিচ, ভুট্টা, কলাসহ সবজিতে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষিরা।

কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে গেলে ধানে চিটা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেখানে নীলফামারীতে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ওঠানামা করছে ৪০ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

ডোমার চিকনমাটি এলাকার বাদামচাষি আনোয়ারুল ইসলাম জানান, তীব্র তাপপ্রবাহে মলিন হয়ে যাচ্ছে তার ক্ষেতের বাদাম গাছ। যে মাটিতে সোনা ফলান, সে মাটিই যেন শুকিয়ে প্রাণহীন। মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় ফসল রোপণ করলেও খরায় চোখের সামনে নষ্ট হচ্ছে। মাটিতে রস নেই। বৃষ্টিও হচ্ছে না। সেজন্য বাদামের দানাও ছোট হয়ে যাচ্ছে। মেশিনের পানি দিলে ৫ দিনও থাকে না সেই পানি। রোদে সব শুকিয়ে যায়। ধুঁকছে প্রাণিকুল: টানা তাপপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন পোল্ট্রিশিল্পে জড়িতরা। তীব্র গরমে প্রতিদিন মারা গেছে হাজার হাজার মুরগি। এর প্রভাবও পড়েছে বাজারে। গরু গরমে খাওয়া কমিয়ে দেওয়ায় কমেছে দুধের উৎপাদন। ওজন কমছে কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা গরুর। এতে খামারিরা রয়েছেন চিন্তায়। অতি গরমে বিভিন্ন পাখির মৃত্যুর খবরও সামনে এসেছে।

গত ২৫ এপ্রিল এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) জানায়, তীব্র তাপপ্রবাহে ১০ দিনে প্রান্তিক খামারিদের ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। সংগঠনটির দাবি, চলমান তাপপ্রবাহের ফলে হিটস্ট্রোকের কারণে সারাদেশে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ মুরগি মারা যাচ্ছে, যার আনুমানিক ক্ষতি দিনে ২০ কোটি টাকা।

গবাদি পশুর খামারিদের অবস্থাও ভালো নয়। চলতি মাসে দেশে এক কোটি ৩০ লাখ গবাদিপশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। এ অবস্থায় তীব্র তাপপ্রবাহে সারাদেশে প্রায় দুই হাজার গবাদিপশু মারা গেছে। কোরবানিযোগ্য গরুগুলো ওজন হারাচ্ছে গড়ে ৩০ থেকে ৭০ কেজি। এছাড়া ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হারে কমেছে দুধের উৎপাদন। তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব বগুড়া কাহালু উপজেলায় দরগাহাট এলাকায় ১৪০টি গরু লালনপালন করছেন তার খামারে। এর মধ্যে ১২০টি কোরবানিযোগ্য। তার খামারে কোনো গরু মারা যায়নি। তবে সোমবার পর্যন্ত কাহালু উপজেলায় মারা যায় ৯টি গরু। বিপ্লবের পরিচিত গাইবান্ধার একটি খামারে একই দিনে ৭টি গরু মারা যাওয়ার খবরও দেন তিনি।

দৈনিক সরোবর/এএস