ঢাকা, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১

যুক্ত হলো লাগেজ ভ্যান: ট্রেনে কৃষিপণ্য পরিবহনে শঙ্কা

সরোবর প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৩, ০৫:৪২ বিকাল  

আয় বাড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেনে নন-রেফ্রিজারেটর লাগেজ ভ্যানে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে রাজধানী শহর ঢাকায় পরিবহন করে আনা হবে মালামাল। আর রেফ্রিজারেটর লাগেজ ভ্যানে পরিবহন করা হবে কৃষকের উৎপাদিত শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মাংস ও দুধের মতো হিমায়িত পণ্য। এ উদ্দেশে বাংলাদেশ রেলওয়ের আন্তঃনগর ট্রেনে রবিবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হলো ‘লাগেজ ভ্যান’।

এর আগে করোনাকালীন ঢাকায় খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পার্সেল ও কৃষি পরিবহন ট্রেন চালু করেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। সে সময় রেলেওয়ের কৃষি সেবায় সাড়া দেয়নি কৃষকরা। ফলে কৃষি পণ্যের অভাবে কয়েকদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় রেলওয়ের কৃষি পরিবহন সেবা।

রেলওয়ের বাণিজ্যিক বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, করোনার সময় রেলওয়ে যেভাবে আশা করেছিল, কৃষকের ফসলাদি-কৃষি পণ্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু আশানুরূপ সেভাবে সাড়া পাওয়া যায়নি। ওই ট্রেন ৭ দিন চালানোর পর মালামাল না পাওয়ায় সেটি আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কৃষিপণ্য পরিবহনে চীন থেকে ৩৫৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকায় ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কিনেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এর মধ্যে ৭৫টি মিটারগেজ লাইনের ট্রেনে ও ৫০টি ব্রডগেজ লাইনের আন্তঃনগর ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। ৬০টি সাধারণ লাগেজ ভ্যানের মধ্যে ব্রডগেজ লাইনে ৩০টি ও মিটারগেজ লাইনে ৩০টি থাকছে। এছাড়া ২৮টি এসি লাগেজ ভ্যানের মধ্যে ব্রডগেজ লাইনে ১২টি ও মিটারগেজ লাইনে ১৬টি থাকছে।

রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৬টি ট্রেনে প্রাথমিকভাবে ১৬টি লাগেজ ভ্যান সংযোজন করা হয়েছে।

রবিবার বেলা ১১টা ২০ মিনিটের দিকে দেশের প্রধান ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও অন্যান্য মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে আন্তঃনগর ট্রেনে আধুনিক লাগেজ ভ্যান সংযোজনের উদ্বোধন করেন রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন।

এর আগে গত ১১ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছিলেন, প্রতিটি ট্রেনে একটি করে লাগেজ ভ্যান সংযুক্ত করা হবে। এর মধ্য দিয়ে ট্রেনে যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি পণ্যও পরিবহন করা যাবে। আন্তঃনগর সেবা পাওয়া যাবে।

উদ্বোধনের আগেই একটি হ্যান্ডবিল তৈরি করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সেখানে বলা হয়, ব্যবসায়ী এবং সর্ব সাধারণের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় মালামাল পরিবহনের জন্য ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে লাগেজ ভ্যান যুক্ত করা হচ্ছে। যার মাধ্যমে  স্বল্প খরচে এবং স্বল্প সময়ে মধ্যে মালামাল পরিবহন করা হবে। ব্যবসায়ীদের এবং সর্ব সাধারণকে মালামাল পরিবহনের জন্য নিকটস্থ স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ট্রেনের বাড়তি খরচ ও ঢাকার বাজারের সঙ্গে সিডিউল মিল না থাকায় কৃষিপণ্য পরিবহনে আগ্রহী হবে না কেউ।

কারওয়ান বাজারের সবজি ব্যবসায়ী আব্দুল মোতালেব বলেন, যখন ট্রাকে মাল আনা হয় তখন ট্রাকগুলো কৃষকের একদম ক্ষেতের কাছ থেকে নিয়ে আসে। কৃষক ক্ষেত থেকে সরাসরি ট্রাকে মাল লোড করে ঢাকায় পাঠায়। এতে তার প্রায় ৩টি খরচ কম হয়। ট্রেনে আনতে গেলে খরচ বেড়ে যাবে, পণ্যের মূল্যও বেড়ে যাবে।

আরেক ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবীর বলেন, রেলের এই সেবায় কৃষকের পণ্য পরিবহনে খরচ বেশি হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত কৃষককে ক্ষেত থেকে পণ্য তুলে সেগুলো নিকটবর্তী স্টেশনে পৌঁছাতে হবে। সেই মাল ট্রেনেেউঠাতে লেবার খরচ রয়েছে। ট্রেনের ভাড়া আছে। ঢাকায় আবার লেবার খরচ আছে। তারপর আবার সেগুলো বাজারে পৌঁছাতে হবে। এতে কৃষকের শুধু খরচ না, একই সঙ্গে আরও বেশি সময় ব্যয় হবে। অন্যদিকে ট্রাকগুলো কৃষকের ক্ষেত থেকে মাল নিয়ে সরাসরি ঢাকার বাজারে পৌঁছায়।

তিনি আরো বলেন, সিডিউল টাইমে ট্রেন স্টেশনগুলো থেকে ছেড়ে যায়। সেগুলো ভোর পাঁচটার পর থেকে ঢাকায় ঢুকতে শুরু করে। কমলাপুর স্টেশন থেকে সেগুলো ছাড়িয়ে বাজারে আসতে পৌঁছাবে সকাল ৯টা। সেই মাল তো ওইদিন আর বিক্রি হবে না। কারণ ততক্ষণে পাইকারি বাজারের কেনা-বেচা শেষ হয়ে যায়।

এদিকে যাত্রীবাহী ট্রেনে লাগেজ ভ্যান যুক্ত হলে যাত্রী সেবায় বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে মনে করেন অনিন্দ দাস অন্তু। তিনি বলেন, আন্তঃনগর ট্রেনগুলো মধ্যবর্তী স্টেশনে ২/৩ মিনিট দাঁড়ায় যাত্রী ওঠানামা করার জন্য। সেখানে টন পরিমাণ মালামাল লাগেজ ভ্যানে উঠাতে আরও সময় লাগবে। এতে আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী সেবায় বিঘ্ন ঘটতে পারে। কারণ, এমনিতেই নির্ধারিত সময়ে ট্রেনগুলো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। তার ওপর আরও সময় ব্যয় হলে যাত্রীরা বিরক্ত হবেন।

জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, রেলওয়ে হিমায়িত পণ্য ডোর টু ডোর সার্ভিস দিতে পারবে না। কারণ এটার জন্য যে পরিমাণ অপারেটিং কস্ট আসবে, সেটা দিয়ে টেকসই কিছু হবে না। মালামালগুলো স্টেশনে পড়ে থাকবে। কৃষকরা কৃষি পণ্য পরিবহনে আগ্রহী হবে না। সমীক্ষা ছাড়াই নতুন নতুন প্রকল্প নেওয়ার কারণে এমন হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী জানিয়েছেন, ডোর টু ডোর সার্ভিসটা যদি আমরা নিশ্চিত করতে পারতাম বা পারি এবং মার্কেটিং যদি এভাবে সাজিয়ে নিতে পারি, তাহলে এটার ভবিষ্যৎ আছে। এটা নিয়ে আমরা এখন ভাবছি, কীভাবে কি করা যায়।

আন্তঃনগর ট্রেনে আধুনিক লাগেজ ভ্যান সংযোজন উদ্বোধন করে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলেছি। আড়ৎদার ও বড় বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি। যেহেতু এটা মাত্র শুরু করলাম, তাই ভবিষ্যতে এটাকে বহুমুখী করার জন্য অন্যান্য পরিবহনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আসতে হবে। আমরা এজেন্ট নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছি। রেল নিয়ে কোন ব্যবসা করতে চাই না। আমরা ফেসিলিটিসটা দিতে চাই। আপাতত ১৬টি ট্রেনে একটি করে লাগেজ ভ্যান দিচ্ছি। চাহিদার ওপর নির্ভর করে আমরা লাগেজ ভ্যান বাড়াবো।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, রেলের আয়ের অন্যতম খাত পণ্য পরিবহন। আর এটি করা হয় লাগেজ ভ্যানের মাধ্যমে। বর্তমানে রেলওয়েতে ৪১টি মিটারগেজ ও ১০টি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান আছে। সেগুলোর বেশির ভাগের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। ফলে পণ্য পরিবহন থেকে যথেষ্ট আয় করতে পারছে না রেলওয়ে। এখন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নতুন করে অত্যাধুনিক ৭৫টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান সংযোজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

মোট চুক্তি মূল্য ৩৫৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা (৭৫টি মিটারগেজ লাগেজ ভ্যানের চুক্তি মূল্য ১৮৩ কোটি ২৪ লাখ এবং ৫০টি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যানের চুক্তি মূল্য ১৭৫ কোটি ১৫ লাখ)। ইতোমধ্যে ২টি চালানে ৫০টি মিটারগেজ লাগেজ ভ্যান বাংলাদেশে পৌঁছেছে। কমিশনিং ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ২৪ সেপ্টেম্বর ১ম দফায় ১৬টি লাগেজ ভ্যান পরিচালনার শুভ উদ্ভোধন হলো। অবশিষ্ট ২৫টি মিটারগেজ লাগেজ ভ্যান এবছর অক্টোবর মাসে এবং পরবর্তী ৫০টি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সরবরাহ পাওয়া যাবে।

এর আগে সরকার ২০১৮ সালের ২৬ জুন পণ্য পরিবহন ও যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে আধুনিক, নিরাপদ ও গুণগত মানসম্মত রোলিং বহরে স্টক যুক্ত করার লক্ষ্যে ৩ হাজার ৬০২ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন প্রকল্পের (রোলিং স্টক সংগ্রহ) অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ২ হাজার ৮৩৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ঋণ দেবে। প্রকল্পের মেয়াদকাল ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত হলেও পরে তা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়।