ঢাকা, বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫, ১১ চৈত্র ১৪৩১

ঢাকাকে জিডিআইয়ে যুক্ত করতে মরিয়া চীন, কৌশলী বাংলাদেশ

সরোবর ডেস্ক

 প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২৫, ০৫:৩৪ বিকাল  

চীন জিডিআইয়ে বাংলাদেশকে যুক্ত করতে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশকে যুক্ত হতে ২০২২ সালে প্রস্তাব দেওয়া হয়। বিগত সরকারের সময়ে এ নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হতে গিয়েও আটকে যায়। তবে এখনও হাল ছাড়েনি দেশটি।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে আগামী শুক্রবার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হবেন। ওই বৈঠকে জিডিআই প্রসঙ্গ তুলতে পারে বেইজিং। তবে প্রধান উপদেষ্টার সফরে জিডিআই সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক সই না হওয়ার কথাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টার সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশকে প্রায় ১৫টির মতো সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তাব দিয়েছে চীন, যার মধ্যে জিডিআই ছিল। কিন্তু এখনই এ সমঝোতা স্মারক সই করবে না বলে বেইজিংকে জানানো হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ যে ইতিবাচক সেটিও তাদের জানানো হয়েছে। সেজন্য এ সফরে জিডিআই নিয়ে আগের অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও নতুনত্ব চায় বেইজিং। ফলে এবার জিডিআইয়ের প্রশংসাসূচক ‘ভাষাগত’ কিছু পরিবর্তন আনতে রাজি হয়েছে ঢাকা। অর্থাৎ চীনকে আশ্বস্ত করা হবে আমরা আপনাদের এই উদ্যোগ ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। সঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে এ সংক্রান্ত ঘোষণা দেওয়া হবে।

জিডিআই কী?:চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগের (জিডিআই) ঘোষণা দেন। তিনি বলেছিলেন, করোনা মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, সমন্বিত ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নের ধারা নিশ্চিত করতে হলে বিশ্বকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। এটি চীনের একটি বৈশ্বিক পরিকল্পনা। যেখানে তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে যুক্ত করতে চায়। এখন পর্যন্ত চীনের এ উদ্যোগে যোগ দিয়েছে ৬০টিরও বেশি দেশ।

জিডিআই নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান: স্থানীয় এক কূটনীতিক বলেন, জিডিআইয়ে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এই সফরে এ সংক্রান্ত কোনো সমঝোতা হবে বলে মনে হয় না। তবে আমরা ভাষাগত একটু পরিবর্তন আনব। এ ব্যাপারে আমরা ক্রমাগত ভারসাম্যসূচক ভাষা বা শব্দ ব্যবহার করে আসছিলাম, সেখানে কিছু পরিবর্তন আনা হবে। এবার হয়তো প্রশংসা করব এই উদ্যোগের; এ রকম কিছু একটা থাকতে পারে। তবে ঠিক কোন শব্দ যুক্ত করা হবে সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। মূল কথা হলো, আমরা একটা বেটার ল্যাঙ্গুয়েজ দেব, আগের অবস্থান থেকে একটু বের হব।

জিডিআইয়ে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন রোববার সাংবাদিকদের বলেন, জিডিআইয়ে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

তবে এতে যুক্ত হতে আপত্তির কিছু দেখছেন না বলে জানান তিনি।

চীনে দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, জিডিআই নিয়ে বাংলাদেশ একটু ধীরে চলো নীতিতে চলছে। হয়ত আমরা চট করে যেতে চাই না। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) যুক্ত আছি, এটা তো জিডিআইয়ের বাইরে না। জিডিআইয়ে হয়ত আমরা এমনি যুক্ত থাকব, কিন্তু কোনো চুক্তি বা এমওইউ করব না। জিডিআইয়ে আমাদের যেতে বাধা দেখছি না। হয়ত চীনের গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভে (জিএসআই) আমরা যাব না।

২০২২ সালের আগস্টে ঢাকা সফর করেছিলেন চীনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং উ-ই। সেই সফরে চীনের প্রেসিডেন্টের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) ও গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ (জিএসআই)-এর মতো উদ্যোগে বাংলাদেশকে যুক্ত হতে প্রথম প্রস্তাব দেওয়া হয়।

বিগত সরকারের সময়ে পররাষ্ট্র-সচিব পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমনকি শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে চীনের দিক থেকে জিডিআইয়ে যুক্ত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। এ নিয়ে বিভিন্ন কূটকৌশল অবলম্বন করেছে বেইজিং। তবে বিগত সরকার নানা কৌশলে জিডিআইয়ে যুক্ত হওয়া থেকে বিরত ছিল।

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের জুলাইয়ে চীন সফর করেছিলেন। ওই সফরে গিয়ে জিডিআই সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক সই করার প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত সরে আসে বাংলাদেশ। অর্থাৎ শেখ হাসিনা সফরে যাবার আগে চীনকে জানানো হয়, এই সমঝোতা স্মারকটি সই হবে না। এ নিয়ে চীন কিছুটা বিরক্ত হয়েছিল।

গত বছরের ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর চীন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘ধীরে চলো’ নীতিতে ছিল। তবে ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আসার চেষ্টা করে বেইজিং। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার পালাবদল হয়। সব মিলিয়ে বেইজিংয়ের আগ্রহের সঙ্গে কিছুটা হলেও তাল মেলায় ঢাকা।

অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে তিনি প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে বেইজিং যান। তার সফরটি বেশ সফল হিসেবে দেখছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

ওই সফরে বাংলাদেশের পাওয়ার পাল্লাই ভারি। কেননা—ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানো, সুদহার কমানোর আশ্বাস, কুনমিংয়ের তিনটি হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ, ঢাকায় চীনের একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণসহ সাংহাই-কুনমিং-চট্টগ্রামের মধ্যে ফ্লাইট চালুর সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশে ফেরে প্রতিনিধি দল। ওই সফরে উপদেষ্টা ও তার সঙ্গীদের আতিথেয়তায় নজির স্থাপন করে চীন। ঢাকা থেকে নিরাপত্তা দিয়ে তাদের বেইজিংয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। একইভাবে ঢাকায় পৌঁছে দেওয়া হয়।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বেইজিং সফরে চীন আবারও জিডিআই প্রসঙ্গ তোলে। ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় প্রধান উপদেষ্টার সফরের জন্য প্রস্তাবিত সমঝোতা স্মারকের মধ্যে জিডিআইও রাখে চীন।

এক চীন নীতিতে ২০ বছর আগের প্রতিশ্রুতিতে ফিরতে চায় চীন

বিগত সরকারের সময় থেকে বাংলাদেশ এক চীন নীতির প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে আসছে। আর তাইওয়ানকে চীনের অংশ হিসেবে মেনে আসছে। ২০২৪ সালের বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার একটি যৌথ ঘোষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশ এক চীন নীতির প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে, চীন সরকার সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাইওয়ান চীনের অংশ।

কিন্তু বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসতে চাইছে চীন। বেইজিং ঢাকাকে প্রস্তাব দিয়েছে, এক চীন নীতিতে ২০ বছর আগে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেখানে যেন পুনরায় ফিরে যাওয়া হয়। অর্থাৎ তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময়ে ২০০৫ সালে এক চীন এবং তাইওয়ানের ব্যাপারে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশ যেন সেটাই সমর্থন করে এবারের যৌথ বিবৃতিতে যুক্ত করে।

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় এক কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশ চীন নীতির প্রতি অব্যাহত সমর্থন দিয়ে আসছে। বাংলাদেশ তাইওয়ানকে চীনের অংশ মনে করে। কিন্তু চীন ২০০৫ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে ফিরতে চায়। কিন্তু এটা বাংলাদেশ করবে কি না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।

২০০৫ সালে তৎকালীন চীনের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে এক চীন নীতির বিষয়ে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, চীন একটাই, চীন সরকার পুরো চীনের বৈধ সরকার এবং তাইওয়ান চীনের অংশ।

জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার বেইজিং সফরে ছয় থেকে আটটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে। পাশাপাশি এ সফরে চারটি ঘোষণা আসতে পারে। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশকে এক থেকে দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তার ঘোষণা দেবে চীন। এছাড়া মোংলা বন্দরের আধুকিয়ানে অর্থায়নের বিষয়টিও যুক্ত থাকবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তরা জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা আগামী ২৬-২৯ মার্চ চীন সফর করবেন। তিনি ২৬ মার্চ (বুধবার) চীনের পাঠানো একটি উড়োজাহাজে ঢাকা থেকে রওনা হবেন। ২৭ মার্চ দেশটির হাইনান প্রদেশে আয়োজিত বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার (বিএফএ) সম্মেলনে যোগ দেবেন ড. ইউনূস। সম্মেলনের উদ্বোধনী প্লেনারি সেশনে বক্তব্য দেবেন তিনি। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে চীনের স্টেট কাউন্সিলের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রিমিয়ার দিং ঝুঝিয়াংয়ের বৈঠক হতে পারে।

২৮ মার্চ বেইজিংয়ের ‘গ্রেট হল অব দ্য পিপল’-এ শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন ড. ইউনূস। একই দিনে হুয়াওয়ে কোম্পানির উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন এন্টারপ্রাইজ পরিদর্শন করবেন তিনি। ২৯ মার্চ চীনের বিখ্যাত পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করবে এবং সেখানে তিনি বক্তব্য রাখবেন। পরে বেইজিং থেকে চীনের একটি বিমানে ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার।

দৈনিক সরোবর/এএস