ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫, ১১ চৈত্র ১৪৩১

পরিবারের একাধিক সদস্য টিসিবি ট্রাকের পণ্য নেওয়ার অভিযোগ

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: মার্চ ২৩, ২০২৫, ০৭:২৩ বিকাল  

রমজান ঘিরে নিত্যপণ্যের চাহিদা বেড়েছে। এতে বিপাকে পড়েছে স্বল্প-আয়ের মানুষ। এ অবস্থায় সাশ্রয়ী মূল্যে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য পেতে গভীর রাত থেকেই সরবরাহকারী ট্রাকের সামনে ভিড় করতে দেখা যায় শত শত নারী ও পুরুষকে। কেউ কেউ আবার সেহরি খেয়েই পণ্যের আশায় লাইনে দাঁড়িয়ে যান। সকাল গড়িয়ে বেলা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে টিসিবির ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে তাদের। ট্রাক থেকে প্রতিদিন পণ্য পান চারশ’জন। কিন্তু লাইনে দাঁড়ান ছয় থেকে সাত শতাধিক মানুষ। তবে অনেকেই পরিবারের একাধিক সদস্যদের দিয়ে পণ্য নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফলে অনেক মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে।

জানা গেছে, দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে টিসিবির পণ্য ক্রয়ের জন্য দরিদ্র, এমনকি নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও ট্রাকের লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে। বাজার থেকে সয়াবিন তেল, ডাল, চিনি, ছোলা ও খেজুর না কিনে টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। উদ্দেশ্য সাশ্রয়ী মূল্যে এসব পণ্য কিনে কিছু টাকা সাশ্রয় করা। কিন্তু এই লাইন ক্রমে লম্বা হচ্ছে। নির্ধারিত স্থানে টিসিবির ট্রাক আসার চার-পাঁচ ঘণ্টা আগে থেকেই মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। 

কারওয়ান বাজার ওয়াসা সংলগ্ন রাস্তার গলি পথে শনিবার মধ্যরাতে লাইনে দাঁড়ানো মাহবুব, নজরুল ইসলাম, মোসলেম ও সাহাজান বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। টিসিবির পণ্য স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায়। এ কারণে টিসিবির পণ্য কিনতে আসছি। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত প্রচণ্ড রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য নিয়ে বাসায় যেতে পারিনি। এ কারণে শনিবার মধ্যরাতে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি।’ 

মুক্তা, মোরশেদা, হোসনে আরা ও লিপিসহ একাধিক নারী একই কথা বলেছেন। তাদের অভিযোগ, পণ্য বিক্রির দিনে ২-৩ দিন ধরে ৬-৭ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও নিত্যদ্রব্য কিনতে না পেরে খালি হাতে বাসায় যেতে হয়েছে। তারা আরও বলেন, ওয়ার্ডের ফ্যামিলি কার্ডধারী লোকজন বেশি। ডিলাররা পণ্য বিক্রির সময় একটি বুথের মাধ্যমে টাকা নেন, কার্ডে স্বাক্ষর দেন ও পণ্য দেন। সে কারণে ভোগান্তি হয়। মানুষের সমাগম অনুযায়ী পণ্য বিক্রির বুথের সংখ্যা বাড়ানো হলে ভোগান্তি কমে যেত।  এখানে স্বজনপ্রীতিই বেশি চলে বলে তারা অভিযোগ করেন।

ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ হচ্ছে মানুষের সারি। দীর্ঘ অপেক্ষার পরও খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে অনেককে

টিসিবির ডিলার মেসার্স শ্রাবণ এন্টারপ্রাইজের মালিক তালাত মাহমুদ চৌধুরী বলেন, প্রতিদিন নগরের ২০টি পয়েন্টে ২০ জন ডিলারের মাধ্যমে ৪০০ জন করে গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে চাল, ডাল ও তেল নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করছি। ৪০০ জনের জন্য পণ্য নিয়ে যাওয়ার পর অনেকে না পেয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরে যান।  

টিসিবির কর্মকর্তারা জানান, আগে টিসিবি বিভাগীয় শহরে ৬০টি, ঢাকা সিটিতে ৫০টি, চট্টগ্রাম সিটিতে ২০টি মিলিয়ে ১৩০টি ট্রাকে পণ্য বিক্রি করত। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলাতেই টিসিবির ট্রাকে করে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। আগে প্রতি ট্রাকে পণ্য সরবরাহ করা হতো ২০০ জনের জন্য। চলতি মার্চ থেকে প্রতি ট্রাকে পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে ৪০০ ক্রেতার জন্য।

রামপুরা এলাকার গৃহিণী সালেহা খাতুন জানান, গত সপ্তাহে একদিন দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়েও তিনি পণ্য না পেয়ে ফিরে যান; যার কারণে লাইনে দাঁড়ানোর জন্য শনিবার সেহেরীর পর নির্দিষ্ট স্থানে এসে অপেক্ষারত বসে আছেন। এখান থেকে পণ্য কিনলে কিছু টাকা বেঁচে যায়, যার কারণে কষ্ট হলেও রাতেই চলে এসেছেন। এদিকে টিসিবির ট্রাকে পণ্যের ওজন কম দেওয়ার অভিযোগ করেছেন রামপুরার আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘কিছুটা কম দামে পণ্য কেনার আশায় মানুষজন ট্রাকের সামনে ভিড় করে। কিন্তু বিক্রয়কর্মীরা প্রতি কেজিতে ডাল, চিনি ও ছোলা ৫০ গ্রাম করে কম দেন।’ দুই কেজি ডাল, দুই কেজি চিনি ও এক কেজি ছোলাতেই প্রায় ২৫০ গ্রামের মতো ওজন কম দিচ্ছেন বলেও তিনি জানান। একই কথা জানান রিকশাচালক সাদিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, অন্যান্য পণ্যের মতো ৫০০ গ্রাম খেজুরে ৫০ গ্রামের মতো ওজন কম দেয় টিসিবির ডিলাররা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গত মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে ৯.২৪ শতাংশে নেমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যসহ সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখনো নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ের অনেক ওপরে। মানুষের প্রকৃত আয় বাড়ছে না। এ কারণে নিয়মিত টিসিবির ট্রাকের সামনে সুলভে পণ্য কিনতে আসা মানুষের ভিড় বাড়ছে। পণ্যের সরবরাহ বাড়িয়েও অপেক্ষমাণ মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না টিসিবি। দ্বিগুণ পণ্য বিতরণের বিষয়ে টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে ৬৩ লাখ ফ্যামিলি কার্ডের বাইরে দেশে ৬৪ জেলায় ৪১০টি ট্রাক সেলের মাধ্যমে সুলভ মূল্যে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। আমরা আমাদের সামর্থ্যের সবটুকু চেষ্টা করছি; যেন কেউ খালি হাতে ফিরে না যায়। টেন্ডার-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত পণ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যাতে পণ্য সরবরাহে কোনো ধরনের ব্যাঘাত না ঘটে।

রমজান মাসে নিম্মআয়ের মানুষদের কাছে স্বল্পমূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দিতে সরকার দেশের ৬৪টি জেলায় ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে টিসিবি পণ্য বিক্রির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। গত ৫ মার্চ থেকে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ভর্তুকি মূল্যে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ২৮ মার্চ পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলমান থাকবে। ৩৯০ টাকা প্যাকেজ মূল্যে দুই লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি মসুর ডাল এবং এক কেজি চিনি বিক্রি করা হচ্ছে। 

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ