ঢাকা, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩১

চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধির প্রতিবেদন দাখিল

এসএম সামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২৪, ০৮:৪১ রাত  

সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি বেশ পুরনো। অবশেষে চাকরিপ্রত্যাশীর জন্য আসছে সুখবর। স্থায়ীভাবে বাড়ছে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা। এর পাশাপাশি বাড়ানো হচ্ছে অবসরে যাওয়ার সময়ও। এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ চলছে। এ সংক্রান্ত পর্যালোচনা কমিটি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর সুপারিশ করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আগামী সপ্তাহে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হতে পারে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। 

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স পুরুষের ৩৫ ও নারীদের ক্ষেত্রে ৩৭ বছর করার সুপারিশ করার পর দ্রুত এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির দাবি জানিয়েছেন আন্দোলকারী চাকরিপ্রার্থীরা। দাবি আদায়ে আজ সোমবার রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীদের অন্যতম সমন্বয়ক ইমতিয়াজ হোসেন। চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ন্যূনতম ৩৫, শর্ত সাপেক্ষে উন্মুক্ত করার প্রজ্ঞাপন চেয়ে আজ শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন তারা। যা ৩৫ প্রত্যাশী সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দের ব্যানারে এ কর্মসূচি পালন করা হবে। রাষ্ট্র সংস্কারে সরকার যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে, এর মধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনের প্রধান হয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। এই কমিশনও বয়সসীমার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। 

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে সরকার এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে সরকার জনপ্রশাসন সংস্কারের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করেছে। চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়স বাড়াতে সুপারিশ করবে কি না, তা এ কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত। 

এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রবেশের বয়স ৩৫ করা হলে সরকারে আন্দোলনকারীদের ঝামেলা থেকে মুক্ত হবে। আর অবসরের বয়সসীমা বাড়ালে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের প্রতি অনুগত থেকে নতুন উদ্যমে কাজ করবেন। মূল বিষয়টি হলো, জনগণকে সুশাসন কীভাবে দেওয়া যায় তা নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে এ কমিশন যদি মনে করে, সরকারি চাকরিতে ঢোকার বয়স ও অবসরের সীমা বাড়ানো প্রয়োজন, তারা সরকারকে সুপারিশ দেবে। তবে চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা কত বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে এবং সেটি কত বাড়তে পারে, তা সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলছেন না। শুধু বলেছেন, প্রবেশের বয়সটি বাড়তে পারে; যা সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সাধারণ বয়স ৩০ বছর। তবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২ বছর।

তিন বছর বাড়তে পারে প্রবেশ ও অবসরের বয়সসীমা। পুরুষের ৩৫ এবং নারীর ৩৭ বছর করার সুপারিশ

এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারি চাকরিতে বয়স বাড়ছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সচিব আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি এরই মধ্যে বয়স বাড়ানোর বিষয়ে সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে জমা দিয়েছেন। বয়স কত বাড়ছে জানতে চাইলে সচিব বলেন, কমিটি বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। প্রধান উপদেষ্টা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৩ বছর করা হতে পারে। আর অবসরের বয়সসীমা হতে পারে ৬৩ বছর। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বছর। মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণ করা আছে। আবার সাধারণ প্রার্থী অর্থাৎ অমুক্তিযোদ্ধা প্রার্থীদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর এবং অবসরের বয়সসীমা ৫৯ বছর।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থীরা ৩২ বছরের সুবিধা ভোগ করছেন। তাদের সঙ্গে এক বছর বাড়িয়ে অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ প্রার্থীদের জন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা সমান করে ৩৩ বছর নির্ধারণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা ৬৩ বছর করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটার চাকরিজীবীরা অবসরে যাচ্ছেন ৬০ বছর বয়সে। তারা এক বছরের পোস্ট-রিটায়ারমেন্ট লিভ (পিআরএল) ভোগ করেন। অর্থাৎ তারা ৬১ বছর চাকরির সুবিধা ভোগ করছেন। অর্থাৎ পিআরএলের সময়টা ছুটি না দিয়ে চাকরিতে অন্তর্ভুক্ত করলে চাকরি এক বছর এমনিতেই বেড়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধা কর্মচারীদের অবসরের বয়সসীমা ভিত্তি ধরে দুই বছর বাড়িয়ে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা-নির্বিশেষে সবার জন্য ৬৩ বছর নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর আগে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা ৬২ করার জন্য তৎকালীন জনপ্রশাসনমন্ত্রীকে আধাসরকারিপত্র (ডিও) দিয়েছিলেন।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর নির্ধারণের দাবিতে দীর্ঘ প্রায় এক যুগ ধরে আন্দোলন করছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। সর্বশেষ গত ২৯ সেপ্টেম্বর চাকরিপ্রত্যাশীরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এক পর্যায়ে চাকরিপ্রত্যাশীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। চাকরিপ্রত্যাশীরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করা ছাড়া স্থান ত্যাগ করবেন না বলে জানিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। ওই বৈঠক থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়; সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে যৌক্তিক বয়সসীমা নির্ধারণে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হচ্ছে। ওই দিন বিকেল চারটায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব গণমাধ্যমকে জানান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সচিব আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের যৌক্তিক বয়সসীমা নির্ধারণে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে কমিটিতে আরো তিনজন সদস্য বাড়িয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়।

এ বিষয়ে সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, চাকরিতে ঢোকার বয়স ৩০ নির্ধারণ করা আছে মূলত ক্যাডার সার্ভিসের জন্য। এ ছাড়া নবম থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত এ বয়স প্রযোজ্য। তবে অনেকেই জানেন না, এর চেয়ে বেশি বয়সেও সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থা ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ আছে। সেখানে ৪০, ৪৫ বছর বয়সেও চাকরি মেলে। যারা চাকরির বয়স ৩৫ করতে আন্দোলন করছেন, তারা হয়তো ক্যাডার সার্ভিসের চাকরি ঘিরে আন্দোলন করছেন। তিনি বলেন, আমি মনে করি, বিসিএসের জন্য যে বয়স নির্ধারণ করা আছে, সেটিই সঠিক। ৩০-এর বেশি বয়স বাড়ানো ঠিক হবে না। এখন প্রতিবছর বিসিএসের সার্কুলার হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেভাবে সেশনজট নেই। 

বয়স হঠাৎ বাড়িয়ে দিলে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যাও বেড়ে যাবে; পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা জটিল হবে। এতে যারা বারবার পরীক্ষা দেবেন, তারা অভিজ্ঞতার কারণে পরীক্ষায় ভালো করবেন, চাকরি পাবেন। নতুন যারা চাকরির পরীক্ষা দিতে আসবেন, তাদের মাঝে হতাশা কাজ করবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো যৌক্তিক। অন্তত দুই থেকে তিন বছর হলেও বাড়ানো উচিত।

 দৈনিক সরোবর/ কেএমএএ