ঢাকা, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১

হঠাৎ আলোচনায় সেক্রেটারিয়েট ক্যু 

সরোবর ডেস্ক

 প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৪, ০৬:১৮ বিকাল  

অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাসপূর্তির দিনে গত রোববার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক মতবিনিময় সভায় যোগ দেন হাসনাত আব্দুল্লাহ। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে তার ‘অনুগত লোকেরা’ নানান সমস্যা সৃষ্টি করে নতুন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে। প্রত্যেকদিন সিচ্যুয়েশন ডেভেলপ করে, প্রত্যেকদিন...এখন নেক্সট উইকে যে ক্যু-টা হতে যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে সেক্রেটারিয়েট ক্যু। 

বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ’র সম্প্রতি সরকারি আমলাদের নিয়ে একটি মন্তব্য করেছেন, যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মহলে বেশ আলোচনা হতে দেখা যাচ্ছে। তার এই বক্তব্যের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে একদিকে যেমন ‘সচিবালয়ে ক্যু’ নিয়ে কৌতুহল তৈরি হয়েছে, তেমনি কেউ কেউ প্রতিক্রিয়াও দেখাচ্ছেন। “স্বৈরাচারের দোসরদের” প্রতিহত করার জন্য প্রয়োজনে ফের রাজপথে নামবেন বলেও জানাচ্ছেন অনেকে।

এদিকে, দায়িত্ব নেওয়ার একমাস পরেও প্রশাসনিক কাজে খুব একটা গতি ফেরেনি বলে জানাচ্ছেন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। তাহলে কি সত্যিই অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে প্রশাসনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে? প্রভু চলে গেছে, কিন্তু দাস যায় নাই: সচিবালয়ে ক্যু’র শঙ্কা প্রকাশ করে দেওয়া নিজের যে বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, সেটির বিষয়ে বিবিসি বাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।

আব্দুল্লাহ বলেন, এখানে ক্যু বলতে আমরা বোঝাতে চাচ্ছি যে, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের একটি অংশ অন্তর্বর্তী সরকারকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করছে না। ফলে প্রশাসনিক কাজে এক ধরনের স্থিতাবস্থা তৈরি হতে যাচ্ছে। বিপ্লবী পরবর্তী সময় হিসেবে এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন দৃশ্যমান হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়ার পরেও সেই পরিবর্তন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। আর এটি ঘটছে প্রশাসনের ওইসব কর্মকর্তাদের কারণে, যারা অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে চাচ্ছে।

মূলত নতুন সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করতেই ওইসব আমলারা ঠিকমত দায়িত্ব পালন করছেন না বলে মনে করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গত ৮ অগাস্ট নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার শপথ নেওয়ার পর থেকেই নানান ‘ষড়যন্ত্র’ চলছে বলেও অভিযোগ করেছেন এই সমন্বয়ক।

আব্দুল্লাহ বলেন, ইতোমধ্যে বিচারবিভাগ ও আনসার বাহিনীর ক্যু’র চেষ্টা সবাই দেখেছে। প্রতি মূহূর্তেই সরকারকে এরকম নতুন নতুন ষড়যন্ত্র ফেস করতে হচ্ছে, যার ফলে দেশ গড়ার কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার তৃতীয় দিনের মাথায় 'ক্যু' চেষ্টার অভিযোগ তুলে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

এমন পরিস্থিতিতে তখনকার প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের অন্য বিচারকরা পদত্যাগে বাধ্য হন। ওই ঘটনার পরে প্রশাসনসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও বড় রদবদলের দাবি তোলেন আন্দোলনের সমন্বয়করা। গত এক মাসে প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে ব্যাপক রদবদল হতে দেখা গেছে। স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নতুন করে বদলি, পদায়ন ও নিয়োগ করা হয়েছে কয়েকশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। অনেকেই হয়েছেন বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও (ওএসডি), বেশ কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া পুলিশ মহাপরিদর্শক, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন চেয়ারম্যানসহ আগের সরকারের চুক্তিভিত্তিক বেশিরভাগ নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি, আধা-সরকারি, এমনকী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের আগের সব কমিশনারসহ কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদ ছাড়ছেন, আবার বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ, অপমান-অপদস্তসহ নানান চাপের মুখে কর্তা ব্যক্তিরা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। এমন কী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিবাদের মুখে সরকারের একজন উপদেষ্টার দায়িত্বেও পরিবির্তন আনতে দেখা গেছে। কিন্তু এতকিছুর পরও সরকারি কাজে গতি আসছে না কেন? ‘কারণ প্রভু চলে গেছে, কিন্তু দাস যায় নাই;-বিবিসি বাংলাকে বলেন সমন্বয়ক আব্দুল্লাহ। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার গত ১৬ বছরে নিজেদের লোকজন বসিয়ে প্রশাসনে যে সেটআপ রেখে গেছে, তাদেরকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিলে কাজে গতি ফিরবে না।
 
কী বলছেন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা?: সরকারি কাজে গতি আনতে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে আরও রদবদল প্রয়োজন বলে মনে করছেন প্রশাসনিক ক্যাডারদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনে’র (বিএএস) আহ্বায়ক ও অতিরিক্ত সচিব ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ। তবে আমলাদের ক্যু’র যে আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে, সেটি ঘটনার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন তিনি। ‘এটা ঠিক যে, কাজে গতি ফেরাতে আরও রদবদল ও সংস্কার করা প্রয়োজন। তবে ক্যু হওয়ার মতো পরিস্থিতি আমরা দেখছি না। আগের সরকারের সময়ে যারা অনিয়ম ও অনৈতিকভাবে সুবিধা নিয়েছেন, বিভিন্ন পদে বসেছেন, তারাই মূলত এখন সরকারকে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন’-বিবিসি বাংলাকে বলেন আনোয়ার উল্ল্যাহ। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধা পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারিদের একটি অংশ বর্তমান সরকারকে সহযোগিতা করছে না বলে যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি স্বীকার করছেন এই কর্মকর্তা। এর বাইরেও কিছু কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনে অনিহা দেখাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। বলেন, এর মধ্যে একটি গ্রুপ হচ্ছে, দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিরা। অর্থলোভ ছাড়াও ধরা পড়া ও শাস্তির ভয়ে অনেকে ঠিকমত কাজ করছেন না।

এছাড়া কয়েক মাসের মধ্যেই যারা অবসরে চলে যাবেন, তাদের মধ্যেও কেউ কেউ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছেন না বলে জানিয়েছেন তিনি। বলেন, কাজেই এসব মানুষকে চিহ্নিত করে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি অভিজ্ঞ সৎ, নিষ্ঠাবান, দক্ষ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়া গেলে সাধারণ মানুষ সুফল ভোগ করবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে একটি সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা। সেখানে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ, নিরপেক্ষ ও জনবান্ধব করে গড়ে তোলাসহ বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। ‘এখন যেহেতু একটি নিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, সেজন্য আমরা মনে করি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ করার এটাই উপযুক্ত সময়। তাহলে কেউ অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না’- বলেন আনোয়ার উল্ল্যাহ।

অভ্যন্তরীণ সমস্যার বাইরে ‘মব বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা’র নানান কর্মকাণ্ডও সরকারি কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন সরকারের অতিরিক্ত এই সচিব। সরকার যা বলছে: অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে প্রশাসনের কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলে জানাচ্ছেন উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার।তিনি বলেন, কাজে একটু ধীরগতি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তার মানে এই না যে, প্রশাসনের সাথে সরকারের কোনো ঝামেলা হচ্ছে। দলীয়করণের ফলে প্রশাসনে যে বড় ক্ষতি হয়ে গেছে, সে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে অল্প কিছু কর্মকর্তা ছাড়া বাকি সবাই সরকারকে সহযোগিতা করছে। তবে কিছু কর্মকর্তা যে সরকারকে অসহযোগিতা করছে, সেটি স্বীকার করছেন তিনি। নিয়ম মেনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। বলেন,অন্যায়-অনিয়ম করে যাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছিল এবং যারা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না, তাদেরকে সরিয়ে সেখানে আমরা দক্ষ ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিচ্ছি।

এছাড়া বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সংস্কার প্রস্তাব বিবেচনা করার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন এই উপদেষ্টা। কিন্তু তারপরও সরকারি কাজে গতি আসছে না কেন? মজুমদার বলছিলেন, পরিবর্তনটা যেহেতু দীর্ঘদিন পরে হলো, সেই কারণে ঘুরে দাঁড়াতে একটু সময় লাগছে। তবে খুব শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে প্রত্যাশা সরকারের।

বিবিসি বাংলাকে উপদেষ্টা মজুমদার বলেন, যেখানে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, সেগুলো আমরা নিচ্ছি। একটু সময় লাগলেও ইনশাল্লাহ কিছুদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এটি ঘটছে, কারণ সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। যেসব সমস্যার কথা তারা গত ১৬ বছরে বলতে পারেনি, সেগুলোতে তারা রাতারাতি সমাধান চাচ্ছে, যা সম্ভব না।

তিনি আরো বলেন, পুলিশ বাহিনী, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সেবাখাত গুলোতে দলীয়করণের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে, সেটি কাটিয়ে উঠতে আরেকটু সময় লাগবে। দাবি আদায়ে আন্দোলন, বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, চাপ সৃষ্টি করাসহ নানান কিছু ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এসব কারণে পুলিশসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা অনেক সময় ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। এছাড়া ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতার’ কারণেও যে কর্মকর্তারা অনেক সময় নিয়ম মেনে কাজ করতে পারছেন না, সেটিও স্বীকার করেছেন উপদেষ্টা। সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

দৈনিক সরোবর/এএস