ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১

রপ্তানি আয় বাড়িয়ে দেখানোর নেপথ্যে

সরোবর ডেস্ক

 প্রকাশিত: জুলাই ০৯, ২০২৪, ০৮:৩২ রাত  

রফতানির মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর একটি খাতকে নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভুল তথ্য প্রকাশের এমন ঘটনায় একই সঙ্গে বিস্ময় ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশে রফতানির বাৎসরিক হিসেবে প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি দেখানোর ঘটনা বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

মূলত একটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি থেকে শুরু করে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নির্ধারণ এবং অর্থনৈতিক নানান নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে রফতানি আয়ের প্রকৃত হিসাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসের রফতানি আয়ের হিসেবে বড় ধরনের অসামাঞ্জস্য ধরা পড়েছে।

ফলে দেশটির জিডিপি, মোট জাতীয় উৎপাদন (জিএনপি), বিদেশি বিনিয়োগ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ঋণ গ্রহণের নীতি লেনদেনের ভারসাম্য-সহ অর্থনীতির অনেক সূচক এবং নীতির যথার্থতা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

‘সব মিলিয়ে এটি দেশের ভাবমূর্তিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। কাজেই কীভাবে এমন একটি ঘটনা ঘটলো, সেটি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন’- বিবিসি বাংলাকে বলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। কীভাবে ঘটল এত বড় ভুল: রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) অসামাঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য নিয়ে সমালোচনার মধ্যেই জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে রফতানির প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সেখানে দেখা গেছে যে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের প্রকৃত রফতানি ইপিবির দেওয়া তথ্যের চেয়ে প্রায় ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কম ছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন তথ্য প্রকাশের পরে ইপিবিও তাদের রফতানির তথ্য সংশোধন করেছে। কিন্তু রফতানি বেশি দেখানোর ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছে, ইপিবির পক্ষ থেকে সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও বক্তব্য জানানো হয়নি।

তবে বিষয়টিকে একটি ‘ভুল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তার মতে, রফতানির একই পণ্যের মূল্য দুইবার ধরে হিসেব করার কারণেই তথ্যে অসামাঞ্জস্য দেখা দিয়েছে।

‘ইপিবির যেটা ভুল হয়েছে, ইপিজেড থেকে যে (কাপড়) রফতানি হয়, (তখন) তা একবার হিসাবে ধরা হয়। আবার (ওই একই কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরির পর) যখন গার্মেন্টস থেকে রফতানি হয়, সেটা আবার ধরা হয়। এখানে ডাবল হিসাব হয়’-রবিবার সাংবাদিকদের বলেন রহমান।

রহমানের মতে, দেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা যখন কাঁচামাল ক্রয় করছে, তখন সেটি রফতানি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কাঁচামালটি দেশেই আরেকটি কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে।

সেখানে কাঁচামাল ব্যবহার করে নতুন চূড়ান্ত পণ্য তৈরির পর যখন সেটি বিদেশে যাচ্ছে, তখন কাঁচামালের রফতানির আগের হিসাব বাদ না দিয়েই নতুন করে পণ্যের পুরো মূল্য বিবেচনা করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। কিন্তু কীভাবে এমন 'ভুল' হচ্ছে, সেটি নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন অর্থনীতিবিদরা। ‘একে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। রফতানির মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে তারা কীভাবে এই ভুল করলো এবং ঠিক কতদিন ধরে এটি চলছে, সেটি ভালোমত তদন্ত করে দেখা দরকার’-সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।

ডলার সংকটের কারণে গত কয়েক বছর ধরেই দেশের লেনদেনের আর্থিক হিসেবে ঘাটতি দেখা যাচ্ছিলো। সম্প্রতি ঘাটতি আরও বাড়তে থাকায় রফতানির প্রকৃত অবস্থা জানতে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং রাজস্ব বোর্ডের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে কমিটির সদস্যরা রফতানির তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই শুরু করে। সেটারই সূত্র ধরে শেষমেশ রফতানির তথ্যে বড় অসামাঞ্জস্য থাকার বিষয়টি সামনে আসে।

ইপিবির তথ্যে বলা হয়, গত অর্থবছরের দশ মাসে দেশে পণ্য রফতানি হয়েছে মোট ৪৭ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ওই একই সময়ে রফতানি আয় এসেছে মাত্র ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

দায় কার: রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রতিবেদনে তথ্যের বড় ধরনের যে অসামাঞ্জস্যতা দেখা যাচ্ছে, সেটির দায় প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি স্বীকার করছে না।

কর্মকর্তরা দাবি করেছেন যে, এনবিআরের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তারা রফতানির তথ্য প্রকাশ করেছেন। ‘কাজেই এটি আমাদের ভুল, সেটি বলা যাবে না’-বিবিসি বাংলাকে বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে রাজস্ব বোর্ড এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ইপিবি যৌথভাবে কাজ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। ‘আমরা একসঙ্গে বসছি এবং সমস্যার মূলটা খুঁজে বের করে সমাধানের চেষ্টা করছি’-বিবিসি বাংলাকে বলেন ওই কর্মকর্তা।

রফতানি পণ্যের মূল্য এবং তার বিপরীতে দেশে আসা রফতানি আয়ের ব্যবধান বাংলাদেশে অনেকদিন থেকেই বাড়তে দেখা যাচ্ছিলো। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেও অতীতে বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে অভিযোগ জানানো হয়েছে। ‘২০২২ সাল থেকেই আমরা বলছি যে, ইপিবির রফতানি তথ্যে ভুল আছে। কিন্তু আমাদের কথা সেভাবে আমলে নেওয়া হয়নি’-বিবিসি বাংলাকে বলেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।

করোনা মহামারির কারণে রফতানি কমে যাওয়ায় বিষয়টি প্রথমে নজরে আসে বলে জানান হাতেম। ‘করোনার মধ্যে আমাদের ব্যবসা খুব একটা ভালো ছিল না। কিন্তু ২০২২ সালের নভেম্বরে দেখা গেলো যে, ইপিবি পাঁচ বিলিয়নের রফতানি দেখিয়েছে। তখনই প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, এই রফতানি আমরা করি নাই।-বিবিসি বাংলাকে বলেন বিকেএমইএ-র নির্বাহী সভাপতি হাতেম। একই অভিযোগ জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-ও (এফবিসিসিআই)। ‘আমাদের যেখানে রফতানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়, সেখানে ইপিবি দেখায় ইতিবাচক। এটি ইপিবি কীভাবে করে, তা আমাদের জানা নেই’-বিবিসি বাংলাকে বলেন এফবিসিসিআই-র সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ।

কিন্তু তারপরও কেন বিষয়টি আমলে নেওয়া হলো না?
‘হয়তো তারা সরকারকে খুশি করার জন্য বেশি রফতানি দেখাতে চেয়েছে, কিংবা অন্য কোনও গ্রুপের স্বার্থেও এই কাজ করে থাকতে পারে’-বিবিসি বাংলাকে বলেন ব্যবসায়ী নেতা হাতেম।

যে প্রভাব পড়তে পারে: বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক দিন ধরেই বিদেশি বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা ও গবেষকেরা বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে সরকারি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে আসছিলেন। ফলে রফতানির তথ্যে গরমিলের যে ঘটনাটি এখন সামনে এসেছে, সেটি দেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে। ‘আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যকে সাধারণত নির্ভরযোগ্য তথ্য হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। কিন্তু এই ঘটনায় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রশ্নের মুখে পড়ে গেছে, যা দেশের ভাবমূর্তির উপরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে’-বিবিসি বাংলাকে বলেন সিপিডি'র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।

একই সঙ্গে, রফতানির ক্ষেত্রে ভুল তথ্য প্রকাশের কারণে অর্থনীতির সূচকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে বলেও মনে করেন তিনি। ‘যেহেতু জিডিপিসহ অর্থনীতির অনেকগুলো সূচক নির্ধারণে রফতানি আয়ের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়, কাজেই সেগুলো নিয়ে এখন প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়’-বিবিসি বাংলাকে বলেন অর্থনীতিবিদ মিজ খাতুন।

এমন অবস্থায় জিডিপি, জিএনপি, লেনদেনের ভারসাম্য, বিদেশি ঋণ গ্রহণের নীতি-সহ অর্থনীতির অনেক সূচক সংশোধন করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে বোঝা যাচ্ছে যে, এসব সূচকগুলো ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়েছিল। ফলে সেগুলো দিয়ে অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না’-বিবিসি বাংলাকে বলেন বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৫.৮২ শতাংশ। এছাড়া মাথাপিছু আয় প্রায় দুই হাজার ৭৮৪ মার্কিন ডলার বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘নতুন করে হিসেব করলে দেখা যাবে এগুলো কমে যাচ্ছে। ফলে উন্নয়নের চমকপ্রদ যে একটা গল্প, সেটা থেকে আমরা কিছুটা সরে আসবো’-বিবিসি বাংলাকে বলেন সিপিডি'র নির্বাহী পরিচালক মিজ খাতুন। একই সঙ্গে, অর্থনীতি বিষয়ক পরিকল্পনা এবং নীতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে বলে জানাচ্ছেন তিনি।

অন্যদিকে, রফতানির ভুল তথ্য প্রকাশের কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং রিজার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। ‘সরকারি তথ্য বা পরিসংখ্যানে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি দেখা দিলে সেটি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করতে পারে। কারণ বিনিয়োগকারীরা অর্থ বিনিয়োগের আগে এসব তথ্য বিবেচনায় নেন’-বিবিসি বাংলাকে বলেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।

আর সে কারণে কীভাবে তথ্যের গরমিলের ঘটনাটি ঘটল, সেটি খতিয়ে দেখা জরুরি বলেও মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ‘কারা এটি করল? কেন করল? এটি নিছকই পদ্ধতিগত ভুল, নাকি তার চেয়ে বেশি কিছু? সেটা দেখা জরুরি’-বিবিসি বাংলাকে বলেন পিআরআইয়ের পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। ‘এর আড়ালে কেউ বাড়তি সুবিধা বা প্রণোদনা নিয়েছে কি না, বা টাকা পাচার করেছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখাটাও প্রয়োজন’-বলেন মি মনসুর। তথ্যসূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

দৈনিক সরোবর/এএস