চূর্ণসম্ভাষণ-৩
আড্ডা নিয়ে কিছু কথা
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩, ০৩:৪৪ দুপুর

বাঙালি আড্ডা প্রিয়। বাঙালিদের মধ্যে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যিনি আড্ডা পছন্দ করে না। হয়তো কিছুটা ব্যত্রিকমও থাকতে পারে। এমন মানুষও পাওয়া যেতে পারে পুরোপুরি আড্ডা এড়িয়ে চলেন। কিন্তু লেখকদের মধ্যে এমন কেউ কি আছেন আড্ডা একদমই পছন্দ করেন না। সযত্নে আড্ডা এড়িয়ে চলেন। আমন্ত্রণ পেলেও যোগ দেন না আড্ডায়। ঘনিষ্ট বন্ধুদের ঘরোয়া আড্ডাতেও হাজির হন না। এ বিষয়ে মনে হয়, থাকলেও কোনও লেখক থাকতে পারেন, আবার নাও পারেন। আড্ডা যে বাঙালি জীবনে দখল করে আছে, বড় অনুষঙ্গ হিসেবেই এবং বাঙালি লেখকদের মধ্যে যথেষ্ট উৎসাহ রয়েছে আড্ডার ব্যাপারে।
লেখকদের আড্ডার সূত্রপাত হয় লেখালেখির সূত্রেই। লেখকরা যখন প্রথমে লেখালেখিতে আসেন, তারা লিটল ম্যাগাজিন বের করেন। কজন মিলে পত্রিকা বের করে নিজেদের লেখক শক্তির জানান দেন। একটি লিটল ম্যাগাজিনকে ঘিরে একটি লেখক গোষ্ঠী তৈরি হয়। সেই লেখক গোষ্ঠী ছোট বড় হতে পারে। বাংলা ভাষার লেখকদের সাহিত্য পত্রিকা ঘিরে আবর্তিত হওয়া ঘটনা লেখকদের উদ্যমের ফল।
বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের উৎসাহ, উদ্যম সংকুচিত হয়ে এসেছে। খোদ ঢাকায় একটি দুটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ হতে দেখা যায়। ঢাকার বাইরের চিত্রেও খুব একটা হেরফের নেই বলে মনে হয়। নতুন লেখকদের মধ্যে লিটল ম্যাগাজিন বের করার উৎসাহ কেন লুপ্ত হল তা বলা মুশকিল। এমনটি বলা যায় যে, প্রকাশের নানা মাধ্যম খুলে যাওয়ায়, নতুন লেখকরা এতে উৎসাহ নন। বিষয়টি দুর্বোধ্য মনে হয়। নতুন লেখকদের প্রকাশের নানা মাধ্যম যে সুলভ এমনটাও বিশ্বাসে আনা মুশকিল।
বাংলাদেশে ব্যবসায়ী পত্রিকার অভাব নেই। সেখানে লেখা ছাপার সুযোগ আছে। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন যে সাহস দেখাতে পারে, তা ব্যবসায়ী পত্রিকা পারে না। ফলে লেখকের আতুঁরঘর লিটল ম্যাগাজিন, এ কথা অনেক প্রসিদ্ধ লেখক বলেছেন।
মাফলাট গলায় রাজা হাসানকে ঘিরে আমরা, রাজা হাসানের পাশে কবি খোকন মাহমুদ। বিপরীতে কবি নেহাল আহমেদ, রাগীব হাসান ও অভিযান প্রকাশনির কর্ণধার ও কবি মনিরুজ্জামান মিন্টু
একটি লিটল ম্যাগাজিন ঘিরে যে লেখক গোষ্ঠী তৈরি হয় এবং এদের মধ্যে আড্ডা অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ আড্ডা স্বাস্থ্যকর। সাহিত্যের জন্য উপকারি তা বলাই বাহুল্য।
ব্যবাসয়ী পত্রিকা ঘিরেও একটা লেখক সম্প্রদায় দেখা যায়, অন্যদিকে লিটল ম্যাগাজিন ঘিরেও একটা লেখক গোষ্ঠী ঝকঝক করে ওঠে। তবে দু ধারার প্রত্রিকার লেখদের মধ্যে যথেষ্ট ফারাক আছে। লিটল ম্যাগাজিনের লেখরা নতুন লেখক, ব্যবসায়ী পত্রিকার লেখকরা নতুন নন, প্রায় লদ্ধ প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে খোদ ঢাকায় লিটল ম্যাগাজিন খুব একটা বের হতে দেখা যায় না বলে নতুন লেখদের দলবদ্ধ হয়ে চলাও খুব একটা দৃষ্টিগোচর হয় না। নতুন লেখকরা পত্রিকা না করলেও হয়তো তারা একত্রে চলেন। নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্টতা বজায় রাখেন। অন্যদিকে ব্যবসায়ী পত্রিকার লেখকরা প্রতিষ্ঠিত, আর প্রতিষ্ঠার একটি ঝলমল ব্যাপার আছে। সেটাও চোখে ধরা পড়তে পারে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে আমার কাছে যেটা মনে হয়, আড্ডাটা থাকা উচিত। আনুষ্ঠানিক আড্ডা বা সাহিত্যের অনুষ্ঠান সেটা নিয়ে কথা বলছি না। বলছি যে, নিদেনপক্ষে যত দেরিতেই হোক, লেখকদের যে আড্ডা চায়ের দোকান, ধূলিমলিন ফুটপাথের পাশে কিছুটা নির্জন জায়গায় একটু বসার জায়গা আছে, সেখানে যে আড্ডা হবে তার মূল্য অসামান্য। ঢাকায় নগণ্য দু-একজন লেখক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ভালো লাগে প্রতীতি জাগে।
আমার নিজ শহরটি প্রসিদ্ধ একটি শহর। এ শহরে যারা একবার আসেন, তারাই মুগ্ধ হন। এখন পর্যন্ত মুগ্ধ হন। ভবিষ্যতে কি হবে তা বলা যায় না। যেহেতু নিজ শহরে বছরের মধ্যে একাধিকবারই যাওয়া হয়। শহরের লেখকদের সঙ্গে ঘনিষ্টতার সূত্রে আড্ডা হয়। এই লেখকদের মধ্যে অনেকে বৃহৎ পরিসরে লেখক খ্যাতিও অর্জন করেছেন। আমার নিজ শহর ঢাকার সন্নিকটে হওয়ায় শহরের লেখকরা রাজধানীতে বসবাস করেন, এমন লেখকদের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে নিতে পেরেছেন। রাজধানী কেন্দ্রিক নানা সাহিত্যের অনুষ্ঠানেও তাদের কেউ কেউ সাদর আমন্ত্রণও পেয়ে অনুষ্ঠানের গৌরব বৃদ্ধি করেন। এটা ভালো লাগার বড় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তবে এদের সঙ্গে মেলামেলা বা আড্ডার সূত্রে যে কথাবার্তা হয়, সেখানে অতিউৎসাহি হয়ে লিটল ম্যাগাজিন বের করার সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেও গ্রাহ্য হয়নি। তবে লক্ষ্যযোগ্য ব্যাপারে হলো নানা অনুষ্ঠান করার প্রতি একটি সুক্ষ্ন ঝোঁক চোখে পড়ে। অনুষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে সাহিত্যের অনুষ্ঠান রয়েছে। এটা যে উপকারি নয় তা বলাটা মস্ত ভুলই হবে। এতেও যে লেখকদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে, সেটা বোধ করি মানতেই হবে।
৮০ দশকের প্রসিদ্ধ কবি রাজা হাসান। তিনি আড্ডা প্রিয় মানুষ। তবে অনুষ্ঠান প্রিয় নন। সাহিত্যের অনুষ্ঠান তিনি রীতিমতো এড়িয়েই চলেন। তিনি যখন ঢাকা থেকে নিজের শহরে আসনে, কিছুদিন থাকেন, আমরা কজন তার সান্নিধ্য পাবার জন্য পাগল হয়ে উঠতাম। এখনও সেটা আছে। তবে তিনি এবং আমি ঢাকায় থাকায়, আকস্মিকভাবে মিলে যায়, দু-জনের নিজের শহরে উপস্থিতি এবং দীর্ঘ সময়জুড়ে কান পেতে তার কথা না শুনলে ভালো লাগে না। অন্যদিকে কবি, কথাসাহিত্যক ও সংগঠক সালাম তাসির। বর্তমানে তিনি সাহিত্যনির্ভর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তিনি আড্ডা প্রিয় মানুষ। অনুজতুল্যদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পছন্দ করেন।
দৈনিক সরোবর/এএস