চূর্ণসম্ভাষণ—২
প্রকাশিত: এপ্রিল ২০, ২০২৩, ০২:০৭ রাত

নিজ শহরের মায়া
এক. সেই সময়ে একজন দুজন লেখালেখির লোকের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে। সেই সময়ে অসম্ভব এক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল, আলাপ হল। খেয়াল করে দেখবেন, লেখালেখির জায়গাটায় অগ্রজ লেখক তার পরের লেখকদের প্রতি একটা মায়া, কৌতূহল সর্বোপরি আগ্রহান্বিত হতে পারেন। অগ্রজ লেখকের কাছ থেকে শেখার অনেক কিছু আছে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি এক দুজন অগ্রজ লেখকের সান্নিধ্য পাইনি, তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ঘটেনি, এমন নয়, কিছুটা স্নেহ আদায় করে নিতে পেরেছি বলে মনে হয়েছে। লেখালেখিতে গুরু শব্দটির কি চল আছে, এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখক-কবি তার পূর্ববর্তী সময়ের একজন কবিকে গুরু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
কিছু বিশ্বাস প্রাক সময়ে স্থাণু হয়ে বসলে তা থেকে যেতে পারে অনেকদিন। প্রথম দিকে পড়া কিছু কথাও মনের কোনে বহুদিন ধরে আলো ছড়িয়ে যেতে পারে। যেমন- একটা কথা খুব ঘনঘন কানে ভেসে আসত বা বইয়ের পৃষ্ঠায় পড়েছি।
কবিতালেখককে মনীষীও হতে হয় অথ্যাৎ প্রচন্ড বিদ্বান বা পন্ডিত তাকে হতে হবে। সমাজে কবির মূল্য কতটুকু সেটা অন্য হিসেবের বিষয় হলেও মনীষী, বিদ্বান, পন্ডিতের মূল্য যে আছে তা সর্বজনবিদিত। সমাজে কবি ছাড়া চলতে পারলে মনীষী, বিদ্বান, পন্ডিত ছাড়া কি চলতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তর অনেকের জানা আছে।
ফলে কবি যদি মনীষী হয় তার আলাদা একটা কদর তৈরি হয়। জানাশোনাপড়া লোক হিসেবে গুরুত্ব বেড়ে যায়। এটা চোখে পড়ার মতো বেশ জৌলুসও ছড়ায়।
আমার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমাদের নিজের শহরের স্থানীয় একটি খবরের কাগজে কবিতার ওপর আমার জ্ঞানগর্ভ একটি লেখা শনাক্ত করে, গুরুত্ব দিতে শুরু করলো কেউ কেউ। তখনই প্রমাণ মিলল যে কবি মনীষী হলে সমাজের চোখে, কখনও লেখকদের চোখেও বাড়তি সমীহ পেয়ে আসেন।
দুই. সেই সময়ে, সেই প্রাণের শহরে একবারই আমি এমন ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলাম, আার কখনও ওপথে পা দেইনি। মানে দ্বিতীয়বার আর কবি থেকে মনীষী হয়ে ওঠার প্রকরণে সংযুক্তি রচনা করিনি। ‘চূর্ণসম্ভাষণ’ নিয়ে পথ চলার চেষ্টা হতে পারে কষ্টসাধ্য। তবে সর্বশেষ মনের ওপরেই নির্ভর করে। নিজ শহরের মায়া সবার মধ্যেই আছে। যে শ্রমজীবী মানুষটি প্রবাসে আছেন, তার মনেও নিজ শহরের মায়া হু হু করে ওঠে। আমার মনে হয়, বহু ক্ষেত্রে নিজ শহরের, প্রাণের শহরের মানুষজন অস্পষ্ট হয়ে উঠলেও খেদ হয়তো থেকে যায়, তবে প্রকৃতিমন্ডল অনন্যরূপেই হাতছানি দিতে থাকে। তার কোলে খেলবার ডাক দেয়।
নিজ শহর বা নিজের শহর মানুষ নানা কারণে ছেড়ে আসে। তার মধ্যে চাকরিই প্রথমে আসবে। পড়াশোনার জন্যও হতে পারে। যে শহরে স্থায়ী হবার বাসনা থাকে, তার জন্য নানা মানুষের সহযোগীতা কাজে লাগে, সেই মানুষ হতে পারে পরিবারভুক্ত-আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব।
একজন লেখক, তিনি, দূরের শহরে যদি চাকরি থাকে সমস্যা নেই। যদি সেখানে পরিবার থাকে তো সমস্যা নেই। কিন্তু মাথা গুজবার ঠাই নেই, পকেটে টাকা নেই, কিন্তু লেখক হবার জন্য গোটা শহর চষে বেড়াচ্ছেন, এমন লেখক বা কবির গল্পও পাওয়া যাবে। এসব খুব একটা নিজ শহরে হয় না। সেখানে যেটা হয়, ধরুন, ঢাকাতেই মানে রাজধানী ঢাকাতেই যেসব লেখক বা কবি চাকরি-বাকরি নিয়ে ভালো আছেন, নিজস্ব ফ্ল্যাট-বাড়ির মালিকও। সমাজের উচুস্তরে উঠাবসা। তাদের কাছে লেখার রাজধানীকে ঠিক লেখার রাজধানী কি মনে হবে, না-কি সহজ একটি করিডোর মনে হবে, যেমন বিকেলে অনেকে বউ-বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে বের হয়, কোনও দামি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বন্ধুরা মিলে খাবে। আর যে লেখক বা কবি, রাজধানীতে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছে, রাজধানীর কোথাও এক চিলতে দাঁড়ানোর জায়গা পেয়ে সে ধন্য; এক টকুরো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, এই গর্বে আত্মহারা হয়েও এটুকু অর্জন তার রক্তঘামকে পানি করে দিয়েছে। আমার ধারনা, এই কবি বা লেখকের রচনার মহাজগতের সঙ্গে সহজ করিডোরে ঘুরে বেড়ানো কবি. লেখকের সঙ্গে পাথর্ক্য আছে। নিজের শহরও সহজ করিডোরের মতোই। তবে তার মায়া আর অন্যত্রের যে সহজ করিডোরের চেয়ে আলাদা করা যায়।
দৈনিক সরোবর/ আরএস