ঢাকা, শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১

অনলাইনে পেজ খুলে চলছে জাল নোটের কারবার

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: মার্চ ২১, ২০২৫, ০৭:১০ বিকাল  

যে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহা এলেই দেশের বাজারে বাড়ে জাল টাকার ছড়াছড়ি। আর এজন্য নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে কারবারিরা। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিবারের মতো এবারও ঈদুল ফিতরের কেনাকাটাকে টার্গেট করে কারবারিরা বাজারে বিপুল পরিমাণ জাল নোট ছেড়েছে বলে তথ্য মিলেছে। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) দুই অভিযানে প্রায় ৮০ লাখ টাকার জাল নোটসহ ধরা পড়েছে দুটি চক্রের পাঁচ সদস্য। তবে ধরা পড়ার আগেই সম্প্রতি তারা দুই দফায় ৫০ লাখ টাকার বেশি জাল নোট বাজারে ছড়ানোর তথ্য জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে। 

জানা গেছে, ফেসবুক, টিকটক ও ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চটকদার সব বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে জাল নোট; এমনকি অনলাইনে পেজ খুলেও চলছে জাল নোটের কারবার। দেওয়া হচ্ছে লোভনীয় সব অফার। শুধু অর্ডার করলেই দেশের যেকোনো প্রান্তে হোম ডেলিভারির সুবিধাও রয়েছে। এক লাখ টাকা সমমূল্যের জাল নোট বিক্রি করছে মাত্র ১০ হাজার টাকায়। তবে ৫০, ২০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বেশি নকল বা জাল করা হচ্ছে। 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জাল টাকা ছাপানোর জন্য উন্নতমানের ল্যাপটপ, প্রিন্টার, হিট মেশিন, বিভিন্ন ধরনের স্ক্রিন, ডাইস, জাল টাকার নিরাপত্তা সুতা, বিভিন্ন ধরনের দামি কালি, আঠা ও স্কেল কাটার ব্যবহার করে চক্রগুলো। এছাড়া গ্রাফিক্সের কাজের জন্য চক্রে রয়েছে বেশ কয়েকজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। নিখুঁতভাবে জাল টাকা ছাপতে তাদের মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। এরা টাকার জলছাপ থেকে শুরু করে অন্যান্য নিরাপত্তার সবই অনেকটা হুবহু নকল করছে। চক্রগুলো সারা বছর ততটা সক্রিয় না থাকলেও ঈদ ও পূজার মতো ধর্মীয় উৎসবগুলো টার্গেট করে জাল টাকার নোট ছাপে। টাকা ছাড়াও মার্কিন ডলার ও রুপি জাল করছে। জাল নোট তৈরির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দেওয়া হয়। কিন্তু তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের একই কাজ শুরু করে। 

প্রতি ১০০ পিস ১০০০ টাকার নোট অর্থাৎ এক লাখ নকল টাকা তৈরিতে খরচ ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। সেই জাল টাকা চক্রগুলো পাইকারি ক্রেতার কাছে ৯ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। পরে পাইকারি ক্রেতা প্রথম খুচরা ক্রেতার কাছে তা বিক্রি করে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায়, এরপর প্রথম খুচরা ক্রেতা দ্বিতীয় খুচরা ক্রেতার কাছে আবার সেগুলো বিক্রি করে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় এবং সবশেষে দ্বিতীয় খুচরা ক্রেতা মাঠপর্যায়ে দোকানে দোকানে গিয়ে বিভিন্ন নিত্যপণ্য কেনার মাধ্যমে সেসব জাল টাকা বাজারে ছড়িয়ে দিয়ে আসল এক লাখ টাকার সমপরিমাণ লাভ করছে। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লোভনীয় ও চটকদার বিজ্ঞাপ। এক লাখ টাকার জাল নোট ১০ হাজার টাকায় বিক্রি

ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘কামরাঙ্গীরচর থেকে জাল নোট তৈরি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে আরও অন্তত এক ডজন কারবারির নাম। ওইসব সদস্যও রয়েছে নজরদারিতে। যেকোনো সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘যারা জাল টাকা বাজারে ছাড়ে তারা সংঘবদ্ধ চক্র। এরা জাল নোট বাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হচ্ছে। চক্রগুলোর সদস্যদের ধরতে অতিরিক্ত গোয়েন্দা নজরদারি রাখলেই সাধারণ মানুষ কিছুটা রক্ষা পেতে পারে।’

জাল টাকা তৈরি থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত কয়েকটি ভাগে কাজ করে থাকে চক্রের সদস্যরা। প্রথমে অর্ডার অনুযায়ী জাল নোট তৈরি, দ্বিতীয় পর্যায়ে এ টাকাগুলো যে অর্ডার দেয় তার কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং তৃতীয় পর্যায়ে জাল টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বছর জুড়ে মাদকের লেনদেন, চোরাই পণ্যের কারবার, স্বর্ণ বেচাকেনাসহ বিভিন্ন অবৈধ লেনদেনের সময় জাল নোট চালিয়ে দেয় চক্রের সদস্যরা। অন্য পেশায় থাকলেও বেশি লাভের আশায় অনেকে এ পেশায় জড়িয়ে পড়ছে।

জাল নোট কারবার চক্রের বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) এসএন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ঈদ বা কোনো বড় উৎসব এলেই জাল নোটের কারবারিরা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। অনলাইনেও এ চক্রগুলো ছবি এবং ভিডিও দিয়ে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেয়। কিন্তু এর ৯০ শতাংশই ভুয়া। এসব চক্রের বিরুদ্ধে আমাদের একাধিক টিম কাজ করছে; গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। এছাড়া সার্বক্ষণিক অনলাইন তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গ্রুপগুলোতে নজরদারি করা হচ্ছে। ডিএমপির একাধিক টিম, ডিবি, সিটিটিসিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় সবাই জাল নোটসংক্রান্ত অপরাধ দমনে কাজ করছে। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘জাল টাকা বিক্রি করি’, ‘জাল টাকা বিক্রি করা হয় স্যার’, ‘জাল টাকার ডিলার’, ‘জাল টাকা বিক্রি বাংলাদেশ ডট কম’, ডিলার জাল টাকার’- এমন নানা নামে পেজ রয়েছে ফেসবুকে। এছাড়া টেলিগ্রামে ‘জাল টাকা’, ‘জাল টাকার লেনদেন’ ও ‘জাল টাকা সেল গ্রুপ’- নামে বিভিন্ন গ্রুপ দেখা গেছে। ঈদ ঘিরে ফেসবুক, টিকটক ও ইনস্টাগ্রামসহ অনলাইনে লোভনীয় ও চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্নভাবে বিক্রি করা হচ্ছে জাল নোট। অগ্রিম অর্ডার নিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এজেন্টদের মাধ্যমে দেওয়া হয় হোম ডেলিভারিও। 

রাজধানীসহ সারা দেশে অর্ধশতাধিক গ্রুপ জাল টাকা তৈরি ও বিপণনে জড়িত। প্রতিটি উৎসবের আগে জাল নোট তৈরির চক্রগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। জাল টাকা তৈরি ও বিপণনের কাজে জড়িত চক্রের সদস্যরা তিন ভাগে বিভক্ত। একটি গ্রুপ অর্ডার অনুযায়ী জাল নোট তৈরি করে, অন্য গ্রুপ টাকার বান্ডিল পৌঁছে দেয়, আরেক গ্রুপ এসব টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেয়।

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ