অসাধু ব্যবসায়ীদের টার্গেট পূরণে সাধারণ মানুষ জিম্মি 

বর্তমানে লাইটার জাহাজগুলো পণ্য রাখার গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছেন আমদানিকারকরা। এভাবে রমজান ঘিরে দেশে ভোগ্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরির পাঁয়তারা চালানো হয়। তবে পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সব পণ্যের সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখা, বাজারে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং বন্দরের কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন রাখা ও নিরাপদ নৌ চলাচলের স্বার্থে মালামাল বোঝাই করার পর লাইটার জাহাজগুলোকে বন্দর সীমানা ত্যাগ করার নির্দেশ জারি করেছে সরকার। রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা। 

সম্প্রতি দেখা গেছে, বন্দরের বহির্নোঙরে মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য বোঝাই করার পর লাইটার জাহাজগুলো যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই বন্দর সীমানার মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় দিনের পর দিন অবস্থান করে; যা পণ্য সরবরা হব্যবস্থায় ও সাধারণ জনগণের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলার পাশাপাশি বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও ভোক্তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সব পণ্যের সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখা, বাজারে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে অতি দ্রুত মাদার জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। দেশের সব বন্দরের কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন রাখা ও নিরাপদ নৌ চলাচলের স্বার্থে মালামাল বোঝাই করার পর এখন থেকে লাইটার জাহাজগুলোকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্দর সীমানা ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

গভীর সাগরে মাদার ভেসেলগুলো (বড় জাহাজ) থেকে যথাসময়ে ভোগ্যপণ্য খালাস না করায় বহির্নোঙরে বাড়ছে বড় জাহাজের সারি। অন্যদিকে লাইটার জাহাজে পণ্য রাখায় প্রতিদিন আমদানিকারকরা মাশুল গুনতে হচ্ছে। এ কারণে রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ারও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ভোগ্যপণ্য নিয়ে ৩৬০টি লাইটার জাহাজ বঙ্গোপসাগরে ভাসছে। 

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান, বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য লোড করার পর কোনো লাইটার জাহাজ বন্দর সীমায় অলস বসে থাকতে পারবে না। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে এবং বাজারে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে জনস্বার্থে এমন নির্দেশ জারি করা হয়েছে।

নিত্যপণ্যে কৃত্রি মসংকট তৈরি করতেই মূলত লাইটার জাহাজগুলোকে গুদাম বানায় আমদানিকারকরা

লাইটার জাহাজ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ৮০০ লাইটার জাহাজ পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত রয়েছে। আমদানিকারকরা পণ্য খালাস না করে প্রায় ২০ শতাংশ লাইটার জাহাজকে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছেন। সেই হিসাবে প্রায় ৩৬০ লাইটার জাহাজ তাদের দখলে রাখায় নৌপথে সিমেন্ট, বালু, ক্লিংকারসহ অন্য পণ্য পরিবহনে গতি কমেছে।

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য নেওয়া; সেখান থেকে ধীরে ধীরে গুদামে নেওয়া; এভাবে যদি ১৫ দিন সময় পার করতে পারে, তাহলে বাজারে স্বাভাবিকভাবে একটা সংকট তৈরি হবে। এ সুযোগে তারা একটা বিশাল অঙ্ক পকেটে ঢোকাতে পারবে। কাজেই ভোগ্যপণ্যের আমদানি হলেই তো হবে না, সেটি পুরোটাই বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় পণ্যের দাম বাড়বে। অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের টার্গেট পূর্ণ করবে এবং সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে থাকবে।’

লাইটারেজ জাহাজ কাদিরিয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক হাজী শফি বলেন, ‘মাসখানেকের বেশি সময় ধরে লাইটার জাহাজগুলোতে পণ্য রেখে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছিলেন আমদানিকারকরা। এটা নতুন কিছু নয়। প্রতিবছরই আমদানিকারকরা এমনটা করে। নৌ-অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সমস্যাটি সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি কোস্টগার্ড, নৌবাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি দেখভাল করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে।’

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা জাহাজ জড়ো হয় বন্দরের বহির্নোঙরে। মাদার ভেসেলের ড্রাফট বেশি হওয়ায় এসব জাহাজ সরাসরি বন্দর জেটিতে ভিড়তে পারে না। এ কারণে ৩০ ভাগ ফিডার জাহাজের সাহায্যে কনটেইনার আনা হয় বন্দর জেটিতে। সেখানে চলে খালাস প্রক্রিয়া। বাকি ৭০ শতাংশ পণ্য বাল্ক জাহাজ থেকে ছোট ছোট লাইটার জাহাজে খালাস করে ৩৮টি নৌরুটে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়। লাইটার জাহাজের ধারণ ক্ষমতা ১ হাজার থেকে ২ হাজার টন পর্যন্ত। এভাবে বন্দরের বহির্নোঙর থেকে বছরে প্রায় ৯ থেকে ১০ কোটি টন পণ্য পরিবহন হয়। 

সরকার ভোগ্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়ায় এবার আমদানিকারক ও ভোগ্যপণ্যের আমদানির পরিমাণ বেড়েছে। গত বছর রমজানকে ঘিরে ২১৪ আমদানিকারক ভোগ্যপণ্য আমদানি করেছিলেন। এবার আমদানি করেছেন ৩৬৫ জন। বর্তমানে বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ জাহাজগুলোতে গম, ডাল, সরিষা, লবণ, কয়লা, পাথর, স্ল্যাগসহ বিভিন্ন পণ্য রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ফারুক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক ফারুক আহমেদ জানান, কোনো ধরনের অসৎ উদ্দেশ্যে আমদানিকারকরা লাইটার জাহাজে পণ্য রাখে না। পণ্য খালাস করে গুদামে নেওয়া, আবার গুদাম থেকে বাজারজাত করা, এসব কাজে ঝামেলা বেশি। তাই ঝামেলা এড়াতে অনেক সময় ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমলে আমদানিকারক এসব পণ্য জাহাজে রেখে দেন।

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য মতে, দেড় মাস আগেও বন্দরের আলফা, ব্র্যাভা ও চার্লি এই তিন বহির্নোঙরে গড়ে ৪০টি মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) পণ্য খালাসে লাইটার জাহাজের অপেক্ষায় ছিল। গত ৩১ জানুয়ারি বহির্নোঙরে জাহাজের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬টিতে। জাহাজের সংখ্যা আরও বেড়ে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৪টিতে। বর্তমানেও অপেক্ষমাণ জাহাজের একই সংখ্যা বিরাজ করছে। 

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ