ঢাকা, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১

ভোজ্যতেলের ভোগান্তিতে ভোক্তারা ক্ষুব্ধ

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৫, ০৩:২১ দুপুর  

আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। এর মধ্যেই সয়াবিন তেলের বাজারে চলছে তেলেসমাতি। ছয় মাসের ব্যবধানে মসুর ডাল কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ১৪০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। মাছ-মাংসসহ একাধিক খাদ্য পণ্যের দামেও রয়েছে অস্বস্তি। তেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো বলছে, ঘাটতি নেই; বরং বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ বেড়েছে। কোনো দোকানে পাঁচ লিটারের বোতল নেই তো কোনো দোকানে এক-দুই লিটারের বোতল নেই। কোথাও আবার একেবারেই উধাও। ফলে প্রতিদিনের রান্নায় প্রয়োজনীয় এ পণ্যের সন্ধানে ভোক্তাকে ঘুরতে হচ্ছে দোকান থেকে দোকানে। বোতল পাওয়া গেলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে। ভোজ্যতেলের বাজারে এমন ভোগান্তিতে ক্ষুব্ধ সাধারণ ভোক্তারা। অন্যদিকে ডিলারের কাছ থেকে চাহিদামতো বোতল না পেয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে খুচরা বিক্রেতাদের । 

জান গেছে, সিন্ডিকেট যেন অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের দেশের মানুষের জন্য। বাজার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি সব শ্রেণির মানুষ। চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, ডিম, মাছ-মাংস সবকিছুর দামে আর্থিক চাপ সামলাতে কষ্ট হচ্ছে ভোক্তার। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বাজারের অবস্থা করুণ। শেখ হাসিনা সরকারের আমলেও সিন্ডিকেট ভেঙে ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে পারেনি। বরং বিভিন্ন সময় শুল্ক ছাড় ও পণ্যের দাম বাড়িয়ে মূল্য ঘোষণা করে চক্রকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস দিলেও তারা কোনো সমাধান দিতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে আয়ের সঙ্গে ব্যয় সামলাতে পারছে না দেশের আপামর মানুষ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সার্বিক অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে দুষ্টচক্রের কবলে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর হাতে পেয়েছে ভঙ্গুর অর্থনীতি। ছয় মাসে এ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও চক্রের ছোবলের প্রভাব থেকে বের করা সম্ভব হচ্ছে না। আর্থিক খাতে দীর্ঘদিন ধরেই শৃঙ্খলা অনুপস্থিত। গত দেড় দশক সুশাসনের অভাবে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিভিন্ন দুষ্টচক্রের উত্থান ঘটেছে। এসব কারণে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো পরিপূর্ণ সুফল মিলছে না। এদিকে বর্তমান সরকারের রাজস্ব আয় এখনো নিম্নমুখী। গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে রাজস্ব আয় বেড়েছিল ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা না বেড়ে বরং কমেছে ১ শতাংশ। এ কারণে সরকারের টাকার সংকট রয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে সরকার ভ্যাট আরোপসহ কিছু খাতে সেবার ফি বৃদ্ধি করেছে। এতে পণ্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে। 

সব শ্রেণির ভোক্তা বাজারে জিম্মি; অন্তর্বর্তী সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের আশ্বাসেও মিলছে না সুফল

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত বছর ঠিক একই সময়ের তুলনায় প্রতিকেজি চাল সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। লিটারপ্রতি ভোজ্যতেল ৯ শতাংশ, কেজিপ্রতি ডাল ৩ শতাংশ, রসুন ১৫.৯১ শতাংশ, হলুদ ২০ শতাংশ, মাছ-মাংস ৭ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজারে সিন্ডিকেট ধরতে সরকারকে গোয়েন্দাগিরি করতে হবে। যেসব বাজারে সিন্ডিকেটের গন্ধ পাওয়া যায়; সেসব বাজারেই হাত দিতে হবে। বড় বড় খেলোয়াড়কে চিহ্নিত করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি দেশের সাধারণ ভোক্তা। সরকারও জানে কারা কোন পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। কী পন্থায় বাড়াচ্ছে। লাগাম দৃশ্যমান টান দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কেন তা করা হচ্ছে না সেটা দেখার বিষয়। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তা যৌক্তিকও। এদিকে হঠাৎ করে বাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও হয়ে যাওয়ায়, তৈরি হওয়া সংকটকে ঘিরে কঠোর অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

সূত্র জানায়, আওয়ামী সরকারের সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় অংশই ছিল তাদের সমর্থিত ব্যবসায়ীদের হাতে। অনেক ব্যবসায়ী পলাতক। দুর্নীতির কারণে কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। ফলে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর সার্বিক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। এতে বিনিয়োগ কমে গেছে। পতিত সরকারের শেষ মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠে। এরপর থেকে নতুন সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। তবে মাঝেমধ্যে ওঠানামা করেছে। জানুয়ারিতে এ হার কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমেছে। সেবা মূলক পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার এখনো ডাবল ডিজিটে। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেশি বাড়ায় স্বল্প-আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। এতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ না হওয়ায় বিদেশি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসছেন না। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই কমে গেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে এফডিআই এসেছিল ৬১ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ১৮ কোটি ডলার। এগুলোর বেশির ভাগই দেশে কাজ করছে-এমন বিদেশি কোম্পানিগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে বিনিয়োগ। পুঁজি হিসাবে নতুন বিনিয়োগ আসেনি বললেই চলে।

এ ব্যাপারে  ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী বলেন, সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য কারা তা সরকারকে আগে বের করতে হবে। উৎপাদনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিংবা আমদানিকারক থেকে পণ্য ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে কয়েকটি হাত বদল হয়। এই পর্যায়ে যারা শক্তিশালী ও যাদের প্রভাব বেশি তারা তাদের নিজের স্বার্থে শক্তি ব্যবহার করে পণ্যের দাম বাড়ায়। তাদের বের করতে হবে। তাই প্রথমে যে পণ্যগুলোর মূল্য বেশি ওঠানামা করছে, সেসব পণ্য আমদানিকৃত হোক বা উৎপাদিত হোক, সেই পণ্যের মূল্য-শৃঙ্খল বিচার বিবেচনা করে দেখা উচিত। সেখানে কারা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে; পণ্যমূল্য কারা নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদের ক্ষমতাকে নষ্ট করা এবং আইনগত ব্যবস্থা বা নীতি পরিবর্তন করে ব্যবস্থা নিলে সিন্ডিকেট ভাঙা সহজ হবে বলে তিনি মনে করেন।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিগত শেখ হাসিনার সরকারের কাছে ভোক্তা কোনো সুফল পায়নি। গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশি। মানুষ চায় দ্রুত কিছু পরিবর্তন আসুক। যেহেতু তারা বিপ্লবী চেতনায় প্রতিষ্ঠিত, তাই মানুষ অ্যাকশন দেখতে চায়। সরকারের একাধিক সংস্থা খুচরা পর্যায়ে তদারকি করে দায় সারছেন এবং শক্তিশালীদের ছাড় দেওয়ায় সিন্ডিকেট ভাঙছে না বলে মনে করেন তারা। 

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ