ঢাকা, বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫, ৪ চৈত্র ১৪৩১

ভোক্তার পকেটে থাবা 

উৎপাদন বাড়লেও নায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক 

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২৪, ০৭:৫৫ বিকাল  

মাঠে কৃষক আর বাজারে ভোক্তা ঠকেই যাচ্ছেন। এর প্রতিকার মিলছে না। ধারাবাহিকভাবে সব সময় এ ধরনের আচরণ চলতে পারে না। মূলত বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে মধ্যস্বত্বভোগীরা অতি মুনাফা লুটছে। ফলে উৎপাদন ও ভোগের সঙ্গে জড়িত দু’পক্ষই ঠকছেন। মাঝপথে বাজার ব্যবস্থাপনা কূটকৌশলের মাধ্যমে কৃষক ও ভোক্তার পকেটে থাবা দিয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থার কারণে মাঠে কৃষক ও বাজারে ভোক্তাদের ঠকতে হচ্ছে। সবজির ভর মৌসুম চলছে। শীতের সবজি বাজারে এসে গেছে। উৎপাদন বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। কিন্তু এসব সবজি কৃষকের মাঠ থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে সড়কে চাঁদাবাজিসহ চার থেকে পাঁচবার হাত বদল হচ্ছে। সবজির চড়া মূল্যের একটা বড় অংশ অর্থাৎ প্রায় ৫০ শতাংশই চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। এতে বাজারে ভোক্তাকে এখনো বেশি দামে সবজি কিনতে হচ্ছে। এছাড়া ভোক্তা চড়া দামে কিনলেও মাঠ পর্যায়ে কৃষক নায্যমূল্য পাচ্ছে না। 

জানা গেছে, দেশের একেক জেলা একেক সবজি উৎপাদনে খ্যাত। যেমন- কাঁচামরিচ উৎপাদনে মানিকগঞ্জ, বেগুন উৎপাদনে যশোর, পটোল উৎপাদনে জয়পুরহাট। এছাড়া করলা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত জেলা পঞ্চগড়। অথচ এবার বন্যা হয়েছে নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, ফেনী, লক্ষিপুর, নোয়াখলীসহ বেশ কয়েকটি কয়েকটি জেলায়। এই এলাকাগুলোতে প্রধান ফসল হলো ধান। এছাড়া কিছু কিছু জায়গায় সবজি উৎপাদন হলেও সেটা পরিমাণে কম। কিন্তু একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বন্যাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে সবজির বাজার থেকে বিশাল অংকের টাকা লুটে নিচ্ছেন। উত্তরাঞ্চলের কৃষক মামুনুর রশিদ প্রতিনিয়ত ফসলি জমিতে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বছরজুড়ে তিনি সবরকম সবজির চাষাবাদ করেন। অনেক আশায় বুক বেঁধে তিনি ১৮ শতক জমিতে ফুলকপি চাষ করেছিলেন। হাঁড়ভাঙা পরিশ্রমের পরও লাভের মুখ দেখতে পাননি তিনি। গত সপ্তাহে স্থানীয় মাছুয়া বাজারে ফড়িয়ার কাছে ফুলকপি বিক্রি করেছেন কেজিপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকায়। অথচ একই পণ্য রাজধানীর বাজারে এসে বিক্রি হচ্ছে চারগুণ বেশি দামে। তার কষ্টের মুনাফা যাচ্ছে ফড়িয়ার পকেটে।

ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থার কারণে মাঠে কৃষক আর বাজারে ভোক্তা ঠকেই যাচ্ছে। কিছুতেই মিলছে না প্রতিকার

জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে সংযুক্ত করে কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে জানিয়ে কৃষি সচিব বলেন, যাতে করে আমরা দেখতে পারি মধ্যস্বত্বভোগী কোথায় কোথায় আছেন। কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সবজির দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারি। সার্বিকভাবে পুরো বিষয়টি নিয়ে আমরা গবেষণা করছি। বাজার নিয়ন্ত্রণে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এই প্রশ্নে কৃষি সচিব বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবস্থা নিয়ে যাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি মধ্যস্বত্বভোগী এখানে একটা ভূমিকা রাখছে। এই মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম কমাতে আমরা কাজ করছি; অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও কাজ করছে।

মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে বাজারে সবজির দাম বেশি বলে মন্তব্য করেছেন কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, সবজির দাম নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। আমরা একটা গবেষণাও করছি কেন সবজির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা আমরা নির্ণয় করতে চাই। তবে আমরা এ পর্যন্ত যে তথ্যগুলো পেয়েছি তা হচ্ছে সব সময় মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ মধ্যস্বত্বভোগী। 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারতীয় পানি ঢলে বন্যা হওয়ায় অনেক সবজির ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে বাজারে সবজি সরবরাহ কমে গেছে। সরবরাহ কম থাকায় হঠাৎ সবজির দাম বেড়ে গেছে। 

যশোরের ভাটভাউর গ্রামের বেগুনচাষি হামিদুর রহমান জানান, সাতমাইল বাজারে বেগুন বিক্রি করেছেন কেজি ২৫ টাকা দরে। অথচ সেই বেগুন রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে কেজি ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। একই পণ্য রাজধানীর হাতিরপুলে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭০ টাকা দরে। স্থানীয় বাজারে কেজি ৬০ টাকায় বিক্রি হওয়া পটোল রাজধানীর পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। অথচ একই পণ্য হাতিরপুলে বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে। এছাড়া এক কেজি বেগুন সাতমাইল বাজারে ৪৫ টাকায় বিক্রি হলেও রাজধানীর বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। অন্যদিকে হাতিরপুল খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭০ টাকা দরে। একই সঙ্গে ছিম রাজধানীর বাজারে বিক্রি হচ্ছে কেজি ১২০ টাকায়; যা স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে।

কৃষক মামুনুর রশিদ বলেন, আমাদের এখানে বন্যা নেই। কিন্তু সবজির দাম আগের মতোই আছে। টিভির খবরে দেখি রাজধানীর বাজারে সবজি চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। অথচ আমাদের এখান থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সবজি রফতানি হয়। রাজধানীতে সবজির দাম বেশি হলে আমাদের এখানে দাম কম কেন? তিনি অভিযোগ করে বলেন, এক ধরনের ফড়িয়া বা অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজি এটা।

দাম বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে কৃষিবিদ ড. আরিফুর রহমান বলেন, দেশের সব জেলায় সবজি উৎপাদন হলেও যাতায়তে কারণে দাম বেড়ে যায়। তবে এ সুযোগেকে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা কাজে লাগিয়ে বড় অংকের টাকা পকেটে ঢুকাচ্ছে। এক ধরনের ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সবজির দাম বাড়াচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। পণ্য উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যায়ে আসতে বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোতে হচ্ছে। এর মধ্যে আছে স্থানীয় ব্যবসায়ী, মজুতদার, আড়তদার, পাইকারি ব্যবসায়ী, প্রক্রিয়াজাতকারী, কেন্দ্রীয় বাজার বা টার্মিনাল, খুচরা বাজার, খুচরা ব্যবসায়ী ইত্যাদি। প্রতিটি ধাপেই সবজির মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আছে নামে-বেনামে চাঁদাবাজি।

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ