ঢাকা, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩১

এসেছে ইতিবাচক সাড়া

রিজার্ভ বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে

এসএম সামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৪, ০৮:২৫ রাত  

এবারের জাতিসংঘ অধিবেশনে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছাত্র-জনতার গণবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে ভারত পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে জানাচ্ছে বাংলাদেশকে নিজের পক্ষে টেনে আনতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে তীব্র বিনিয়োগ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফরেই ১৩ বিলিয়ন ডলার অর্থ পাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এতে করে শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা যোগ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর বাইরেও চীনের প্রস্তাবে বড় বিনিয়োগের সোলার প্লান্ট স্থাপন, নেপালের পক্ষ থেকে জলবিদ্যুৎ, জ্বালানি আমদানিসহ বিভিন্ন খাতে অর্থ সহায়তার বড় আশ্বাস এসেছে বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে। অর্থনীতিবিদরা এটাকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের প্রাথমিক সাফল্য হিসেবে দেখছেন। 

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার আশ্বাসে বোঝাই যাচ্ছে যে, ড. ইউনূস সেখানে বেশ সমীহ পাচ্ছেন। তাকে সবাই আগে থেকে চেনেন, নতুন করে চেনানোর কিছু নেই। তবে এবার তিনি একটি বাড়তি পরিচয় নিয়ে সেখানে অবস্থান করেছেন। সেটি হলো বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। 

তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ প্রায় সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ড. ইউনূস ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গার বৈঠকে বাংলাদেশকে সংস্কারে খরচের জন্য সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। এর মধ্যে দুই বিলিয়ন ডলার দেবে একেবারে নতুন ঋণ হিসেবে আর বাকি দেড় বিলিয়ন ডলার দেবে আগের প্রকল্পগুলো চালিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবে। মোটা দাগে সরকার এই অর্থ ডিজিটাইজেশন, তারল্য সহায়তা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা এবং পরিবহনে খরচ করতে পারবে।

জানা গেছে, বাংলাদেশের আর্থিক খাতের দুরবস্থা বিবেচনায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রত্যেক বৈঠকেই উঠে এসেছে আর্থিক সহায়তার বিষয়টি। আর সব ক্ষেত্রেই এসেছে ইতিবাচক সাড়া। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের জন্য ২০ কোটি ডলার সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট সংস্কারের যে কোনো উদ্যোগে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। 

নিজের পক্ষে টানতে আমেরিকা-চীনের মধ্যে চলছে তীব্র বিনিয়োগ প্রতিযোগিতা

আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি আর লুটপাটে দেশের আর্থিক খাত যখন ভয়াবহ চ্যালেঞ্জে, ঠিক সে মুহূর্তে ত্রাণকর্তা হিসেবে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশেষ করে অর্থ পাচার আর ডলার সংকটে যখন দেশের রিজার্ভ তলানিতে, সেই সময় আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তায় রিজার্ভের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করছেন তিনি। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইএসডিবি) ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাসহ (ইউএসএআইডি) বেশ কয়েকটি সংস্থা ও দেশ বাংলাদেশকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। এসব অর্থ পেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে ডলার সংকট ও রিজার্ভের পতন থেমে দেশের আর্থিক খাত ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারপ্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের জাতিসংঘে উপস্থিতির পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিশিষ্টজনরা উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। এটা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। এর ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে তারা নতুনভাবে চিন্তা করবেন। তারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের খ্যাতি ও ইতিবাচক ইমেজকে মূল্যায়ন করেই সাড়া দিয়েছেন। ড. ইউনূসের সাথে বৈঠকে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা বাংলাদেশকে সংস্কারে খরচের জন্য সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। এর মধ্যে দুই বিলিয়ন ডলার দেবে একেবারে নতুন ঋণ হিসেবে আর বাকি দেড় বিলিয়ন ডলার দেবে আগের প্রকল্পগুলো চালিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবে। মোটাদাগে সরকার এই অর্থ ডিজিটাইজেশন, তারল্য সহায়তা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা এবং পরিবহনে খরচ করতে পারবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের দায়িত্ব নিয়ে প্রথমবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিলেও স্বল্প সময়ে তিনি সেখানে এখন বিশ্বনেতাদের মনোযোগের কেন্দ্রে। আগে থেকেই খ্যাতি ও সমীহ পাওয়া ড. ইউনূস এবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে বাংলাদেশের জন্য নতুন পরিচয় হয়ে উঠেছে। কারণ তিনি বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েবা, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং উইসহ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রনায়ক ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

আইএমএফের প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েবার সঙ্গে বৈঠকে এরই মধ্যে বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে সংস্থাটি। এর পরও সংস্থাটি ড. ইউনূসের নেতৃত্বের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আরো তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে চায়। অন্য এক বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে একটি বড় বিনিয়োগের মাধ্যমে সোলার উৎপাদন প্লান্ট বসাতে চান। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সোলার প্যানেল বানিয়ে সারা বিশ্বে রপ্তানির লক্ষ্য চীনের। এর ফলে এখানে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়বে। বহু লোকের কর্মসংস্থান হবে। চীন মনে করে, সোলার প্যানেলে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় রপ্তানিকারক হতে পারবে।

ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা দেশটির বিপুল জলবিদ্যুৎ বাংলাদেশে রপ্তানি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তিনি জ্বালানি, পর্যটন, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে উভয় দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন। ইউএসএইডের প্রধান সামান্তা পাওয়ার ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। বিল ও মেলিন্ডা গেটসের সিইও মার্ক সুজম্যানও বৈঠক করেছেন। তিনিও পাশে থাকতে চান বলে জানিয়েছেন। আর আইএমএফের প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েবার সঙ্গে করা বৈঠকেও এসেছে নতুন ঋণের আশ্বাস। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর ব্যবস্থাপনা কমিটির সম্মানিত সদস্য ড. সায়েমা হক বিদিশা বলেন, এই ঋণগুলো না নিয়ে সরকারের কোনো উপায় ছিল না। কারণ এটি ছাড়া রিজার্ভের পতন থামানোর আর কোনো উপায় ছিল না। শুধু তাই নয়, দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এখান থেকে কয়েক লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ফলে এ ঋণগুলো পাওয়া গেলে ব্যাংকিং খাত একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে আসবে। সেইসঙ্গে রিজার্ভ বাড়বে এবং ডলারের দামও স্থিতিশীল হবে। এভাবেই দেশের পুরো অর্থনীতি একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে আসবে।

এমন এক সময় ড. ইউনূস আইএমএফপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যখন ঋণ দেওয়ার জন্য সংস্থাটির একটি মিশন বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এরই মধ্যে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে আইএমএফ। এরপরও সংস্থাটি ড. ইউনূসের নেতৃত্বের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আরও তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে চায়। আইএমএফ মনে করে, একটি বিশেষ সময়ে ক্ষমতায় আসা নতুন সরকার অনেক খাতে সংস্কার করবে। এ জন্য তারা পাশে থাকতে চায়। এ অর্থ বাজেট সহায়তা হিসেবে সরকার খরচ করতে পারবে।

 দৈনিক সরোবর/কেএমএএ