ঢাকা, বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

বাজেটে ঋণনির্ভরতা

ব্যবসায়ীদের মূলধন সংকট তীব্র 

এসএম শামসুজ্জোহা 

 প্রকাশিত: জুন ১১, ২০২৪, ০৭:৩৯ বিকাল  

বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যাংক খাতের ওপর চাপ কমানোর প্রত্যাশা থাকলেও তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। এবার বাজেটে খরচের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে আনার চেষ্টা থাকলেও ব্যাংক খাতের ওপর চাপ প্রশমনের তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। ফলে চলতি অর্থবছর ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই হিসাবে আগের অর্থবছরের তুলনায় নতুন অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্র অনুযায়ী বাজেটের ব্যয় মেটাতে সরকারের ঋণনির্ভরতা আরও বাড়ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের জন্যও সরকার বিপুল পরিমাণ ঋণ করতে যাচ্ছে।

ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট আর বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে ভাটা পরিস্থিতির মধ্যেই প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি পূরণে ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়িয়েছে সরকার। সাধারণত অন্যান্য খাত থেকে নির্ধারিত বাজেটের অর্থ সংগ্রহে ঘাটতি থেকে যায়। ফলে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি অঙ্কের ঋণ নিতে হয়। গত অর্থবছরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।

জানা গেছে, আগামী বাজেট হতে পারে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার। এর এক-তৃতীয়াংশ অর্থই আসবে দেশি-বিদেশি ঋণ হিসেবে। ঋণের পরিমাণ হতে পারে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরে ৩১ মে পর্যন্ত সরকার ব্যাংক খাত থেকে নিট ঋণ নিয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের অঙ্ক ৭০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায় শোধ করতে গিয়ে নিট ঋণের চেয়েও দেড়গুণ বেশি টাকা নিতে হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে। ফলে ব্যাংক খাতে টাকার প্রবাহ কমে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ সক্ষমতা হারাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের মূলধন সংকট তীব্র হচ্ছে। সাধারণত গত অর্থবছরের শেষ দুই মাসে সরকার বিপুল পরিমাণে ঋণ নেয় ব্যাংক খাত থেকে।

ঘাটতি পূরণে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের চাহিদা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ২৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। ওই অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ বাড়িয়ে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করে সরকার। অর্থাৎ প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অন্তত ১৮ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ গেছে ব্যাংক খাত থেকে। গত পাঁচ বছরের বাজেট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ব্যাংক খাত থেকে ঋণের চাহিদা তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ঋণের লক্ষ্য ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা; ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা এবং গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্য নির্ধারিত আছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। আর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যাংক ঋণের লক্ষ্য  নির্ধারন করা হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ বেশি নিলে বেসরকারি খাতকে ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে যায় আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। ঋণের টাকার যথাযথ ও সাশ্রয়ী ব্যবহার না হলে এবং বেসরকারি খাত প্রণোদনা না পেলে কর্মসংস্থান কমবে ও মূল্যস্ফীতি বাড়বে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে এক টাকাও ঋণ পায়নি সরকার; তাই ব্যাংকের ওপর বাড়তি চাপ পড়েছে। তখন সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারিত ছিল। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। নতুন অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণ পাচ্ছে না সরকার। উল্টো নিট ১২ হাজার কোটি টাকা আগের ঋণ পরিশোধ করেছে। এবার এ খাত থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারিত আছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার গত এপ্রিলে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশে। ফলে টানা ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি যত বেশিই থাকুক না কেন; সরকারের হাতে আপাতত ব্যাংকঋণের কোনো বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, শুধু ঋণ করে সরকার চালানো যাবে না। সরকারের সুদের ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে; এটা শিগগিরই এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। রাজস্ব বৃদ্ধির চেয়ে সুদের ব্যয় বাড়ছে; এটা বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে সরকার। তাই আয় বাড়িয়ে ঘাটতি কমাতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি দেখে বোঝা যাচ্ছে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের অঙ্ক এবারও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। যদিও বর্তমানে তীব্র তারল্য সংকট মোকাবিলা করছে দেশের ব্যাংক খাত। অন্যদিকে তারল্য সংকটের কারণে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিচ্ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঊর্ধ্ব মূল্যস্ফীতির চাপে বর্তমানে টাকা ছাপানো বন্ধ রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উল্টো বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ শোধ করছে সরকার। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ। ফলে প্রবৃদ্ধির চাকা থমকে দাঁড়িয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি এত বড় হওয়ার কারণেই সুদ পরিশোধ বাবদ বড় অঙ্কের বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে চলতি বাজেটে। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৪০ শতাংশের মধ্যে থাকাকে ঝুঁকিমুক্ত বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ হার বর্তমানে ৩৭ শতাংশেরও বেশি। এ হার এখনও ঝুঁকিমুক্ত থাকলেও রাজস্ব আয় সংগ্রহে ভালো গতি না থাকায় ১০ মাসের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি তেমন ভালো না হওয়ায় (প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ), প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্স) আশানুরূপ চিত্র দেখা না যাওয়ায় বিশেষজ্ঞরা কিছুটা চিন্তিত। ডলারের দাম এখনো সন্তোষজনক মাত্রায় স্থিতিশীল না হওয়ার বিষয়টি তাদের চিন্তা আরও বাড়িয়েছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলো এমনতেই তারল্য ঘাটতিতে রয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারি ঋণ যদি অনেকাংশে বেড়ে যায়, তাহলে এ ঘাটতি আরও বড় আকার ধারণ করবে। তা বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিতে চাপ ফেলতে পারে। এ কারণেই এ বছরের ঘাটতি বাজেট মেটাতে দুটি জায়গায় গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত. পুঁজিবাজার, দ্বিতীয়ত সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রে পিপিপি মডেলের আওতায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা। এতে বিশেষ করে অবকাঠামো খাতের বৃহৎ প্রকল্পগুলোয় বাজেট বরাদ্দের বাইরে অর্থায়ন সম্ভব হবে।


বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুই কারণে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের বেশি ঋণ নেয়া খারাপ। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে যায়। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে, যে চাপ শেষ পর্যন্ত বহন করতে হয় ভোক্তা অর্থাৎ জনগণকে। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে মিটিয়ে থাকে। অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী, টাকা ছাপালে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়, যার পরিণতিতেই ঘটে মূল্যস্ফীতি।

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ