গুম হওয়ার তথ্য আগেই পেয়েছিলেন ব্যারিস্টার আরমান
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৫, ০৩:২৭ দুপুর

পতিত ফ্যাসিট হাসিনা সরকারের আমলে ফাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাশেম আরমান। গুম হওয়ার দুই সপ্তাহ আগেই শেখ হাসিনার পরিবারের এক সদস্যের কাছ থেকে জানতে পারেন তাকে উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে তুলে নেওয়া হবে বা গুম করা হবে।
জানা গেছে, গুম হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে শেখ হাসিনা পরিবারের এক সদস্যের কাছ থেকে আরমান জানতে পারেন তাকে উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে তুলে নেওয়া হবে বা গুম করা হবে। ব্যারিস্টার ডিগ্রিধারী শেখ পরিবারের ওই সদস্য তাকে সতর্ক করে দ্রুত দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি একই বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের আরো দুই ব্যক্তি তাকে দ্রুত দেশ ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
কিন্তু বাবা মীর কাশেম আলীর নির্দেশে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে তিনি দেশে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৬ সালের ৬ আগস্ট ব্যারিস্টার আরমান তার বাবা মীর কাশেম আলীর সঙ্গে সর্বশেষ দেখা করেন। এর তিনদিন পর ওই বছরের ৯ আগস্ট তাকে বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়।
এরপর দীর্ঘ ৮ বছর আয়নাঘরে বিভীষিকাময় জীবন কাটাতে হয় তাকে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান ব্যারিস্টার আরমান।
নিজের লেখা ‘আয়নাঘরের সাক্ষী : গুম জীবনের আট বছর’ বইয়ে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য দিয়েছেন ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাশেম আরমান। সম্প্রতি বইটি প্রকাশিত হয়েছে।
বইটিতে তিনি লিখেছেন, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যেই তিন জায়গা থেকে তিনটি তথ্য পেলাম। প্রথম তথ্যটি পেলাম আমার এমন এক বন্ধুর কাছ থেকে, যিনি শেখ পরিবারের সদস্য। যখন আমি ইংল্যান্ডে বার অ্যাট ল পড়তে গিয়েছিলাম, তখন শেখ পরিবারের এই সদস্যও আমার সঙ্গে বার অ্যাট ল পড়েন। ঘটনাক্রমে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একদিন তিনি আমাকে খুব জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে বললেন। দেখা করতে যাওয়ার পর আমাকে নিয়ে গেলেন এক নিরিবিলি জায়গায়।
তারপর বললেন, এমন কিছু লোকের মুখে তোমার নাম শুনতে পাচ্ছি, যাদের মুখে আমার নিজের নাম শুনলে ইমিডিয়েটলি দেশ থেকে পালিয়ে যেতাম।
এ কথা বলেই তিনি আমার হাত ধরলেন; বললেন, এর চেয়ে বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু এতটুকু বলি, তুমি দ্রুত দেশ থেকে চলে যাও।
এরপর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সেখান থেকে চলে গেলেন তিনি।
বিএনপির এক শীর্ষ নেতার ছেলেও তাকে আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচতে দ্রুত দেশ থেকে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার আরমান তার বইয়ে লিখেছেন, আমার আরেকজন বন্ধু, যার বাবা বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা। এই বন্ধুর সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয় আমার বার অ্যাট ল পড়ার সময়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সব বড় নেতার সঙ্গেই তার যোগাযোগ ছিল। প্রথম বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের দু-তিন দিনের মাথায় তিনিও আমাকে দেখা করতে বললেন। তিনি এর আগেও বাবার মামলার ইস্যুতে আমাকে বিভিন্ন তথ্য দিতেন। আর সেসব তথ্য দেওয়ার সময় তিনি আমাকে একটি নিরাপদ জায়গায় ডেকে নিতেন। কারণ, অন্য কোথাও আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে খুব একটা নিরাপদবোধ করতেন না। সেদিনও আমাকে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে বললেন তার নির্ধারিত সেই জায়গায়। সাধারণত গোপন কোনো আলাপ থাকলে সেখানে দেখা করতে বলতেন তিনি। যথাসময়ে হাজির হলাম সেখানে। কুশলাদির পর তিনি আমাকে বললেন, আব্বা আমাকে বিশেষভাবে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন এই বলে যে, তোমাকে দ্রুত দেশের বাইরে চলে যেতে হবে। তোমাকে নিয়ে সরকার খুব খারাপ ধরনের পরিকল্পনা করছে।
প্রথম তথ্য পেলাম শেখ পরিবার থেকে, দ্বিতীয় তথ্য পেলাম বিএনপির সিনিয়র নেতার ছেলের কাছ থেকে।
এরপর সেনাবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলের কাছ থেকে একইরকম বার্তা পান তিনি। ব্যারিস্টার আরমানের ভাষায়, এক সপ্তাহের মাথায় দৈনিক নয়া দিগন্তের এক সিনিয়র সাংবাদিক জানালেন, আর্মির এক অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল খুব জরুরি ভিত্তিতে আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমার সঙ্গে সেই অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলের পরিচয় ছিল আগে থেকেই। তিনি সরাসরি আমাদের মতাদর্শের না হলেও বিভিন্ন সময় অনেক তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। বাবার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। বাবা জেলে যাওয়ার পর বিভিন্ন তথ্য আদানপ্রদানের জন্য আমি ওই সাংবাদিকের মাধ্যমে জেনারেলের সঙ্গে দেখা করেছি। সাংবাদিক মারফত খবর পেয়ে দ্রুতই জেনারেলের বাসায় গেলাম। তিনি আমাকে পাশে বসিয়ে কোনো ধরনের ভূমিকা ছাড়াই জানালেন, একটি অনুষ্ঠানে এনএসআই প্রধানের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। বিভিন্ন কথার ফাঁকে এনএসআই প্রধান বলেছেন, মীর কাসেমের ছেলে খুব বাড়াবাড়ি করছে। আন্তর্জাতিকভাবে বিচারের যে সমালোচনা হচ্ছে, এর সবকিছুর পেছনে সে দায়ী। তাকে তো এভাবে আর ছেড়ে দেওয়া যায় না! এ কথা জানানোর পর সেই জেনারেল আমাকে বললেন, ইমিডিয়েটলি এবং সম্ভব হলে আজ রাতেই দেশের বাইরে চলে যাও।
সবকিছুর জন্য আমাকে দায়ী করার অর্থ হলো-আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই বিচার নিয়ে যে নেতিবাচক কথাবার্তা হচ্ছে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো সরব হয়ে উঠেছে, দাতা দেশগুলো বারবার এই বিচারের অস্বচ্ছতার বিষয়ে সরকারকে জবাবদিহি করছে, সেসবের পেছনে কে আছে এসব নিয়ে অনুসন্ধান করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। তারা ধরে নিয়েছে- এই কাজগুলো আমার তৎপরতা ও যোগাযোগের মাধ্যমে হচ্ছে।
বাবার নির্দেশনা অনুযায়ী দেশেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন ব্যারিস্টার আরমান
ব্যারিস্টার আরমান লিখেছেন, যখন পরপর তিনটি উচ্চপর্যায় এবং সরকার-ঘনিষ্ঠ জায়গা থেকে আমার প্রতি ওয়ার্নিং এলো, তখন আমি নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে বসলাম। নিজেকেই প্রশ্ন করলাম- আমার কী করা উচিত? ততদিনে বাবার আপিলের রায় হয়ে গেছে। সেটি কার্যকর হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই সময়ে আমি কি সেই মানুষটিকে বিপদের মধ্যে রেখে নিজেকে নিরাপদ করব? যিনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন, স্নেহ-মমতায় বড় করেছেন, পড়াশোনা করিয়েছেন; যিনি আমাকে ভালোবাসেন হৃদয় দিয়ে, যাকে আমি ভালোবাসি শ্রদ্ধার সবটুকু উজাড় করে: তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রেখে চলে যাব?
আমি দেখলাম- নাহ! আমি নিজের বিবেকের কাছে সায় পাচ্ছি না। ঠিক তখনই মনে হলো- সব বিষয়ে যে মানুষটির নির্দেশনা নিয়েই সব সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাকেই এ বিষয়টি জানাব। তিনি আর কেউ নন, তিনিই আমার বাবা। কারা কুঠুরিতে ফাঁসির অপেক্ষায় প্রহর গোনা আমার বাবা। অবশেষে বাবাকেই বিষয়গুলো জানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।
ফাঁসির রায় হওয়ার পর বাবার ডিভিশন বাতিল হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে সাধারণ বন্দিদের চেয়ে রাজবন্দিরা যে কিছুটা বেশি সুযোগ-সুবিধা পেতেন, তা আর ছিল না। তাই সাক্ষাতের ক্ষেত্রেও ছিল নানান বিধিনিষেধ। পরিবারের সদস্যরা মাসে শুধু একবার দেখা করতে পারবে। তবে নিয়মানুযায়ী চাইলে যেকোনো সময় দেখা করার আবেদন করতে পারবেন আসামির আইনজীবীরা; তবে তাও নির্দিষ্ট কিছু ফরমালিটিজ মেইনটেইন করে। আমার এই সুবিধাটা ছিল। আমি বাবার আইনজীবীও। সে হিসেবে যতবার প্রয়োজন, ততবার সাক্ষাতের সুযোগ ছিল। এই সুযোগটাকে কাজে লাগালাম। আইনজীবী হিসেবে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আবেদন করলাম কারা কর্তৃপক্ষ বরাবর। সাক্ষাতের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলাম কয়েক দিন পর, ৬ আগস্ট।
মাঝখানে একদিন পর কারাগারে বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। পরশু দিনের ঘটনাটা তাকে জানালাম। বললাম, তিন জায়গা থেকে আমার কাছে ওয়ার্নিং এসেছে, যেন আমি দেশ থেকে চলে যাই। বাবা তখন খুব বিব্রত হওয়ার ভঙ্গিতে একটা হাসি দিলেন। তিনি এই হাসিটা দিলে আমরা বুঝতাম- তিনি নার্ভাস এবং তা আমাদের বুঝতে দিতে চান না।
বাবা বললেন, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করো বেটা! তুমি দেশেই থাকো, এই মুহূর্তে পরিবারের জন্য তোমার থাকাটা খুব দরকার। আমার দাফন-কাফনের জন্য তো তোমাকে পাশে থাকতে হবে! কথাগুলো শুনে আমি হিম্মত ফিরে পেলাম। দায়িত্বের প্রতি দৃঢ়তার শিহরন জাগল মনের কোণে। আমি মনে মনে নিজেকে বললাম- যতই বিপদে থাকি না কেন, পরিবারের জন্য আমাকে দায়িত্ব পালন করতেই হবে। অন্ধকারের মাঝেই খুঁজে বের করতে হবে আলোকচ্ছটা।
দৈনিক সরোবর/ এএইচ