ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১

ভারতে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ বেড়েছে? 

সরোবর ডেস্ক

 প্রকাশিত: জানুয়ারী ২২, ২০২৫, ০৯:১৪ রাত  

সম্প্রতি ভারতের সংবাদপত্রের পাতায় বা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখলেই নজরে আসছে নানা রাজ্যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়ার খবর। ত্রিপুরা হোক বা আসাম, দিল্লি হোক বা পশ্চিমবঙ্গ–অনেক রাজ্যেরই নানা এলাকা থেকে এ ধরনের খবর আসাটা অনেকটা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়ার খবর আগে এত বেশি মাত্রায় সংবাদমাধ্যমে চোখে পড়ত না, যদিও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ নতুন কিছু নয়। তাহলে কি বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ভারতে আসা মানুষের সংখ্যা সম্প্রতি বেড়ে গেছে?

বিএসএফের তথ্য বলছে, গত বছর অগাস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত অনুপ্রবেশকারী গ্রেফতারের ঘটনা সামান্য বাড়লেও তা আগের দু'বছরের ওই একই সময়কালের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি নয়। তবে কেন সংবাদমাধ্যমে অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়ার খবর বেশি করে ছাপা হচ্ছে?

অনুপ্রবেশ কি বেড়েছে?: ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলের মধ্যে বিএসএফের দক্ষিণ বঙ্গ ফ্রন্টিয়ার অন্যতম বড় সীমান্ত এলাকা এবং এই সীমান্ত দিয়েই মোট অনুপ্রবেশের একটা বড় অংশ ঘটে থাকে।

এই সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী গ্রেফতারের যে সরকারি তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে মাত্র ২৭৮ জন বেশি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী গ্রেফতার হয়েছেন। এদের মধ্যে আবার প্রায় অর্ধেক সংখ্যক এমন বাংলাদেশিও আছেন, যারা ভারত থেকে নিজেদের দেশে ফেরত যাওয়ার সময়ে ধরা পড়েছিলেন।

যদি ৫ অগাস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরের তথ্যের দিকে নজর দেওয়া যায়, তাহলেও ২০২৩ এর তুলনায় ২০২৪ সালে ধরা পড়া বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যায় ফারাক মাত্র ২৬৯ জনে। বিএসএফের দেওয়া তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালে অগাস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৩৩ জন বাংলাদেশি ধরা পড়েছিল। আর ২০২৪ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ১১০২ জন।

এই তথ্য দিয়ে বিএসএফের কর্মকর্তারা বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছেন, দুই বছরের তুলনামূলক গ্রেফতারিতে সামান্য বৃদ্ধি দেখা গেলেও ফারাকটা বিরাট বড় নয় এবং এই সামান্য বৃদ্ধিরও কারণ আছে।

‘গত বছর ৫ অগাস্টের পর থেকে ভারত ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে খুব কড়াকড়ি করছে–মেডিক্যাল ভিসা ছাড়া অন্য ভিসা এক রকম দেওয়াই হচ্ছে না। অথচ দুই দেশেরই বহু মানুষের অন্য দেশে আত্মীয়-স্বজন আছেন, নানা কাজেই তারা যাতায়াত করেন বৈধ পথেই। কিন্তু ভিসা না পাওয়ার কারণে জরুরি প্রয়োজনে তারা অবৈধভাবে আসার চেষ্টা করছেন ‘-বলছিলেন বিএসএফের এক সিনিয়র অফিসার।

'ধরা পড়লে পড়ব!': একদিকে যখন নানা রাজ্য থেকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়ার খবর নিয়মিত বের হচ্ছে, তার মধ্যেই অনুপ্রবেশ বা ভিসা নিয়ে ভারতে এসে এখানেই থেকে যাওয়ার ঘটনাও বেসরকারি সূত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছে বিবিসি।

কলকাতা লাগোয়া একটি অঞ্চলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা বসতি গড়তে শুরু করেন গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে। বছর ১৫ আগে সেখানকার বাসিন্দাদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ীই কয়েক হাজার মানুষ থাকতেন যারা কোনও না কোনও সময়ে বাংলাদেশ থেকে চলে এসে পাকাপাকি বসত গেড়েছেন।

ওই বাসিন্দারাই এখন বলছেন, গত দেড় দশকে আরো কয়েক হাজার নতুন মানুষ যেমন এসেছেন, তেমনই অনেকে আবার দক্ষিণ ভারত বা মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে চলে গেছেন অর্থের বিনিময়ে ভারতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে নিয়ে।

এরা মূলত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলি থেকেই এসেছেন এবং এখনও আসছেন, জানালেন ওই এলাকার এক বাসিন্দা। ‘এই তো কদিন আগে আমাদের দোকানে এক ছেলে এসেছিল–এ বাংলাদেশে আমাদের পাশের গ্রামের মানুষ–তাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম যে কী রে তুই এখনও ফেরত যাস নি! সে জুলাই মাস নাগাদ এসেছিল এখানে। তো জবাব দিল সে আর ফেরত যাবে না,’-বলছিলেন ওই অঞ্চলের অনেক পুরনো এক বাসিন্দা।

তিনি যে ব্যক্তির ব্যাপারে এই কথাগুলো বলছিলেন, তিনি ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান। আবার আরেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কথা জানালেন ওই পুরনো বাসিন্দাই–যিনি সীমান্ত পার হতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন, আদালতেও তোলা হয়েছিল, কিন্তু ভারতে বসবাসকারী তার আত্মীয়-স্বজন বেশ অনেক হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন।

পূর্ব পরিচিত ওই বাসিন্দা বিবিসিকে বলছিলেন, তার এক আত্মীয় সেদিন বলল যে অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল! এরা আসলে মরিয়া হয়ে চলে আসে তো! জিজ্ঞাসা করলে বলে গ্রামে থাকলে খাব কী, ধরা পড়লে পড়ব, তখন দেখা যাবে।

তার কথায়, নিয়মিতই খবর বেরচ্ছে দেখছি আমরা সবাই যে অমুক জায়গায় বাংলাদেশি ধরা পড়েছে। তবে এখানে কারও কোনও দুশ্চিন্তা তো দেখি না।

'উদ্বেগের প্রতিফলন': গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের এটা নজরে আসছে যে গত বছরের ৫ অগাস্টের পর থেকে অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়ার খবর কিছুটা বেশিই প্রকাশিত হচ্ছে সংবাদপত্র-টিভিতে।

আবার এই সময়ের মধ্যেই জঙ্গি সন্দেহে বেশ কয়েকজন এবং বাংলাদেশিদের অবৈধভাবে পাসপোর্ট ও অন্যান্য ভারতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দেওয়ার চক্রের সঙ্গে জড়িত সন্দেহেও গ্রেফতারি হয়েছে আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গে। সে সব খবরও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে সংবাদ চয়নের স্বাভাবিক নিয়মেই।

কিন্তু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলির বেশিরভাগই এমন সব গ্রেফতারের, যাদের সঙ্গে অন্তত প্রাথমিকভাবে কোনও রকম জঙ্গি যোগ অথবা জাল পাসপোর্ট চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ পায় নি পুলিশ বা বিএসএফ।

বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, অগাস্ট মাসের পর থেকে এ ধরনের খবর প্রকাশের দিকে সম্পাদকরা নজর দিচ্ছেন সঙ্গত কারণেই। কলকাতা ও শিলিগুড়ি থেকে প্রকাশিত 'এই সময়' সংবাদপত্রের বিশেষ সংবাদদাতা সুরবেক বিশ্বাস এই মতামত পোষণকারী একজন সিনিয়র সংবাদকর্মী। তবে তিনি শুধু তাঁর কাগজ নিয়ে কথা বলতে রাজি হলেন না। কারণ, তিনি ওই সংবাদপত্রের মুখপাত্র নন। তবে সামগ্রিক ভাবে সংবাদপত্রে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত খবর বেশি করে ছাপা হচ্ছে কি না, এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বললেন, বাংলাদেশ থেকে বেআইনি ভাবে এ দেশে এসেছেন অথবা কারও ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ভারতে থেকে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন–এরকম খবর সব সময়েই পুলিশ আমাদের দেয়, আমরাও প্রকাশ করে থাকি। 

বাংলাদেশের সব সরকারের আমলেই এটা হয়ে এসেছে। নতুন কিছু না।তবে এখন, অগাস্টের পর থেকে প্রেক্ষিতটা বদলেছে। সে দেশে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। সেখানকার সংবাদমাধ্যমেই খবর বেরোচ্ছে যে, সন্ত্রাসী কাজকর্মের অভিযোগে জেলে বন্দি ছিলেন, এমন অনেককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সে রকম কেউ সীমান্তবর্তী আমাদের রাজ্য বা আসামে কিংবা মেঘালয়ে ঢুকে পড়ছে কি না, তার ওপরে নিরাপত্তা এজেন্সিগুলো তো নজর রাখবেই। সে কারণেই হয়তো অনুপ্রবেশকারীরা ধরাও পড়ছে কিছুটা বেশি, খবরও হচ্ছে বেশি।

তিনি আরো বলছিলেন, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়া মানেই বাংলাদেশকে ভিলেন বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। ওই ছাড়া পাওয়া ব্যক্তিরা, যারা সন্ত্রাসী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বন্দি ছিলেন অথবা অন্য কোনও সাধারণ অপরাধী ঢুকে পড়ছে কি না, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা উদ্বেগ কাজ করছে, তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে প্রকাশিত খবরেও।

সমস্যা পুরনো, নজর পড়েছে এখন: বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশের সমস্যা নতুন নয়। দুই দেশের সীমান্তের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও এই সমস্যা বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হওয়ার আগে থেকেই রয়েছে।

বিএসএফ জানাচ্ছে যে এখনও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বহু জায়গাতেই নেই। ‘কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমের নজর এতদিন পশ্চিম সীমান্তেই পড়েছিল। এখন পাকিস্তান নিয়ে উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে গেছে। তাই হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে জাতীয় স্তরে খবর হচ্ছে বেশি করে। অথচ পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিকেরা অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, কাঁটাতারহীন সীমান্তের খবর বহু বছর ধরে করে আসছে,’-বলছিলেন পুণের এমআইটি এডিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সম্বিত পাল।

তিনি বলেন, দিল্লির নির্বাচনেও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ বড় ইস্যু হচ্ছে। বলিউড অভিনেতা সাইফ আলি খানের উপর আক্রমণের ঘটনাতেও মূল অভিযুক্তকে বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই খবরের একটি অন্য প্রভাব রয়েছে। ফলে গণমাধ্যমগুলো এখন এ ধরনের খবর গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

তিনি জাতীয় স্তরের গণমাধ্যমে সংবাদকর্মী হিসাবেও কাজ করেছেন। তিনি বলছিলেন, একটা সময়ে অনুপ্রবেশের খবর প্রকাশ করাতে গেলে আমাদের প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হত। সম্পাদকরা গুরুত্বই দিতে চাইতেন না এ ধরনের খবরে। তবে বাংলা গণমাধ্যমে টুকরো খবর হিসেবে যেত এ ধরনের সংবাদ। কিন্তু জাতীয় স্তরের মিডিয়া এই নিয়ে উৎসাহ দেখায়নি। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। তার জন্য অবশ্য ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিও দায়ী। সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

দৈনিক সরোবর/এএস