ঢাকা, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১

স্বাস্থ্যখাতে জটিলতা নিরসনে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না

সরোবর ডেস্ক

 প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৪, ০৮:৪৪ রাত  

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে নানা জটিলতা আগেও ছিল। তবে এবার অন্তবর্তীকালীন সরকার আসার পর স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে প্রশাসনিক যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, সেটা নিরসনে একদিকে দৃশ্যমাণ কোনও তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে সরকার কী করতে চায় সেটাও স্পষ্ট নয়। ফলে জটিলতা আরও বাড়ছে।

সরকার পতনের পরে আমি প্রায় ৮/১০ দিন ভয়ে হাসপাতালে যাইনি। এখন যাচ্ছি। কিন্তু গত মাসের শেষ দিকে আমার নির্দিষ্ট দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমার অধীনে কোনও রোগী ভর্তি করতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি আমার যেসব রোগী ছিলো তাদেরকেও অন্য চিকিৎসকের কাছে দিয়ে দেয়া হয়েছে।’-কথাগুলো বলছিলেন, একটি বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসক। যিনি নিরাপত্তার খাতিরে তার নাম-পরিচয় প্রকাশে না করার অনুরোধ জানান।

সেই চিকিৎসক আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাচিপের সঙ্গে যুক্ত। সরকার পতনের পর দায়িত্ব থেকে সরিয় দেয়া হবে এটা জানতেন তিনি। কিন্তু কৌশলে তার অধীনে রোগী ভর্তি করতে দেয়া হবে না এমনটা তিনি ধারণা করেননি বলেই জানান সেই চিকিৎসক।

‘আমি আওয়ামী লীগ করি এটা ঠিক। কিন্তু এজন্যই কি আমার দক্ষতার অপচয় করা হবে? অথচ আন্দোলনে আহত অসংখ্য রোগীকে কিন্তু আমরা চিকিৎসা দিয়েছি, সেবা করেছি, যারা পঙ্গুসহ বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রেফার্ড হয়ে এসেছিলো। আমার জন্য আমার রোগীরা কেন বঞ্চিত হবে?’ পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক চিকিৎসকের যে অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশে বিভিন্ন হাসপাতালে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন অনেকেই।

গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই হাসপাতালগুলোতে নানামুখী চাপে আছেন বিশেষত আওয়ামী লীগপন্থী চিকিৎসকরা। হামলার ভয়ে তাদের অনেকেই হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকতে শুরু করলে এর প্রভাব পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানের মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে।

পরিবর্তীকালে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করলেও এখনও বহু চিকিৎসক ‘চাপে থাকার’ কথা জানাচ্ছেন।

অন্যদিকে, স্বাস্থ্যখাতের মূল যে কেন্দ্র স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সেখানকার কার্যক্রমেও অচলাবস্থা। সরকার পতনের পর এটা শুরু হলেও সেই অচলাবস্থার নিরসন এখনও হয়নি।

একদিকে এসব জটিলতা নিরসন অন্যদিকে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা- কোনোটিতেই স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দপ্তর থেকে কতটা কাজ হচ্ছে তা নিয়েও আছে প্রশ্ন।

ঢাকার হৃদরোগ হাসপাতাল। রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। হাসপাতালটিতে কার্ডিয়াক সার্জারি, পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারি এবং ভাস্কুলার সার্জারিসহ বিভিন্ন বিভাগে বিশেষায়িত চিকিৎসা পান রোগীরা।

হাসপাতালের বিশটি ইউনিটের মাধ্যমে দেয়া হতো এসব চিকিৎসা। তবে সম্প্রতি সেখানে ১০টি ইউনিট বাতিল করে দেয়া হয়েছে। ফলে এখন চিকিৎসা চলছে মাত্র দশটি ইউনিটের মাধ্যমে।

হাসপাতাল ঘুরে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, মূলত আওয়ামী লীগপন্থী চিকিৎসকদের দায়িত্ব থেকে সরাতেই ইউনিট বাতিলের এমন সিদ্ধান্ত। যদিও হাসপাতালটিতে রোগীর চাপ আছে। সে অনুযায়ী চিকিৎসকের সংখ্যা অপ্রতুল।

জানতে চাইলে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের নব নিযুক্ত পরিচালক অবশ্য কোনো বিষয়েই আপাতত কথা বলতে রাজি হননি।

যদিও হাসপাতালের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ইউনিট বাতিল মানে ‘চিকিৎসা বাতিল নয়’, ইউনিট প্রধান হিসেবে যে সব বিশেষজ্ঞ ছিলেন তারা এখন চালু থাকা ইউনিটগুলোতে কাজ করবেন।

তবে নির্দিষ্ট কিছু চিকিৎসকের অধীনে রোগী ভর্তির সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে শুধু কৌশলে দায়িত্ব থেকে সরানোই নয়, হাসপাতালটির ফটকের সামনে গিয়ে দেখা যায়, ইতোমধ্যেই সেখানে জনা পনেরো চিকিৎসককে দেখা যাচ্ছে এমন একটি ছবি টাঙিয়ে তাদের অপসারণ এবং শাস্তি চাওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি শুধু যে হৃদরোগ হাসপাতালে তা নয়, ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে বিশেষত আওয়ামীপন্থী চিকিৎসকরা ভীতির মধ্যে আছেন।

কোনও কোনও চিকিৎসকের নাম-ছবি উল্লেখ করে ছাত্র আন্দোলনে হামলার অভিযোগ তোলায় তাদের অনেকেই আর হাসপাতালে যাচ্ছেন না। তবে এসবের বাইরেও অনেকে নানামুখী চাপে আছেন।

আশিকুল হাসান (ছদ্মনাম) নামে একজন চিকিৎসক জানাচ্ছেন, মৃত্যুর হুমকি পেয়ে তিনি হাসপাতালে যেতে পারছেন না। ‘আমি স্টুডেন্ট লাইফে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছি। তবে চিকিৎসক হওয়ার পর আমি কোনও রাজনীতিতে নেই। কিন্তু আমাকেও ফোন করে হুমকি দেয়া হয়েছে, মেসেজ দেয়া হয়েছে। এখন আমি একদিনের জন্যও হাসপাতালে যেতে পারিনি। নতুন ভিসি স্যারকে জানিয়েছি। তিনিও আপাতত অপেক্ষা করতে বলেছেন।’ এছাড়া কোনও কোনও চিকিৎসক হাসপাতালে যেতে পারলেও কোনও ডিউটি পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ। ‘সরকার পতনের পর আমি প্রতিদিনই হাসপাতালে গিয়েছি। আমাকে কেউ বাধা দেয়নি। কিন্তু যেটা করেছে, সেটা হচ্ছে, ডিউটি রোস্টার থেকে আমার নাম বাদ দেয়া হয়েছে। আমি যাচ্ছি, কিন্তু আমার কোনও ডিউটি নেই। যাই আর আসি। বলতে পাারেন, অঘোষিত ওএসডি। হয়তো আমাকে অন্য কোথাও বদলি করা হবে। আমি এখন সেটার অপেক্ষায় আছি।” বলছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক আবুল হাসান (ছদ্মনাম)। অধিদপ্তরে ঢুকতে পারছেন না মহাপরিচালক: হাসপাতালগুলোতে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যেও এটা ঠিক যে, শুরুর তুলনায় এখন হাসপাতালের চিকিৎসা সেবায় অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে।

কিন্তু এর উল্টো অবস্থা স্বাস্থ্য খাতের মূল যে কেন্দ্র সেই স্বাস্থ্য অধিপ্তরের প্রশাসনিক কাজে। প্রতিদিনই সেখানে মূল ফটক আটকে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, মানবন্ধন করছেন চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতের সংগঠনগুলো। এতে করে অধিদপ্তরে আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তারা ভয়ে অফিস করছেন না।

গত মাসের মাঝামাঝিতে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নতুন করে নিয়োগ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নতুন মহাপরিচালক নিযুক্ত হন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরই একজন পরিচালক রোবেদ আমিন। কিন্তু মহাপরিচালক হওয়ার পর একদিনের জন্যও তিনি অধিদপ্তরে ঢুকতে পারেননি।

শীর্ষ পদগুলোতে আরও যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারাও বিক্ষোভাকারীদের ভয়েঅধিদপ্তরে অফিস করছেন না।

কারণ বিক্ষোভকারীরা এসব নিয়োগপ্রাপ্তদের ‘আগের সরকারের সুবিধাভোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের অপসারণ চায়।

এসব আন্দোলনে বিভিন্ন সংগঠন থাকলেও একটা বড় শক্তি হিসেবে কাজ করছে বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)।

অধিদপ্তরের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, মহাপরিচালক, পরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ কক্ষগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। ফলে অধিদপ্তরের প্রশাসনিক কাজেও অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। জরুরি কাজে এসে ফিরে যেতে দেখা গেছে বিভিন্নজনকে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মহাপরিচালক অফিস করছেন সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে।

কিন্তু অধিদপ্তরে যখন অচলাবস্থা, স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ ব্যহত হচ্ছে, তখন বিক্ষোভাকারীরা কেন রাস্তা ছাড়ছেন না?

জানতে চাইলে ড্যাবের সভাপতি অধ্যাপক হারুন আল রশীদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, অধিদপ্তরে কার্যকর কোনও পরিবর্তন হয়নি। সব চলছে আগের মতোই।

তিনি বলেন, এখানে দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। দুর্নীতিবাজ, অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু আমরা এগুলোর কিছুই দেখছি না। এখানে দৃশ্যমাণ কোনও পরিবর্তন দেখছি না। যা দুয়েকটা হয়েছে, দেখা যাচ্ছে যে স্বৈরশাসক আমলে যারা উপকারভোগী তাদেরই ঘুরেফিরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দেয়া হচ্ছে। যারা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে, আহতদের চিকিৎসা দিতে নিষেধ করেছে, তাকে যদি পলিসি নির্ধারণে দায়িত্ব দেন তাহলে কি সে এই সরকারের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারবে?

নেতৃত্বে সংকট?: বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির অভিযোগ বহু পুরনো এবং অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। এর সঙ্গে আছে দলীয় পরিচয়ে পদায়ন, পদোন্নতিসহ অনিয়মের নানা ঘটনা। সব মিলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, স্বাস্থ্যখাতে সংস্কারের রূপরেখা তৈরি এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে চাপ আছে অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ের উপর। কিন্তু একদিকে যখন অধিদপ্তর অনেকটাই অকেজো, তখন স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দপ্তর থেকেও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে জোরালো কোনও পদক্ষেপ বা কর্মতৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। এমনকি এসব বিষয়ে কয়েকদফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও অধিদপ্তরের কারও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কথা বলতে রাজি হননি। জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বেনজীর আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, নতুন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যখাতে কী করা হবে তার একটা পরিকল্পনা প্রণয়নের দরকার ছিল।

‘স্বাস্থ্য উপদেষ্টা একটা প্ল্যান দিতে পারতেন। ইমেডিয়েটলি উনি কী করবেন, ছয়মাস পর কী করবেন এবং দীর্ঘমেয়াদে কী করবেন এসব বিষয়ে করণীয় ঠিক করা যেতো। কিন্তু সেগুলো দেখছি না। কিছু হচ্ছে কি না, তা-ও জানা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যখাতে জনগণকে জানানো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এতে আস্থা তৈরি হয়’- বলেন আহমেদ।
স্বাস্থ্যখাতে এখন যে পরিস্থিতি সেটা আশাব্যঞ্জক নয় বলেই মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, আগে আমাদের স্বাস্থ্যখাত একভাবে চলছিলো। দুর্নীতি ছিল, অনিয়ম ছিল। কিন্তু কাজের একটা প্রবাহ ছিল। এখন মনে হচ্ছে এটা একটা জলাশয়, যেখানে কোনো স্রোত নেই এবং ভবিষ্যৎও নেই। স্বাস্থ্যের কাজের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে, অধিদপ্তর। অথচ সেটা চলছে না। আপনার যদি কাউকে পরিবর্তন করতে হয়, সেটা করেন। আর যদি মনে হয় এখনকার মহাপরিচালকই থাকবেন, তাহলে তাকে কাজের সুযোগ দিন। এইটুকু যদি মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে উপদেষ্টা দিয়ে কতটা, কী কাজ হচ্ছে সেটা আমরা কীভাবে বুঝবো? সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

দৈনিক সরোবর/এএস