ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান 

লোকসানের চাপ পড়ছে বার্ষিক বাজেটে

এসএম শামসুজ্জোহা 

 প্রকাশিত: জুন ১২, ২০২৪, ০৭:৩৬ বিকাল  

গত মার্চ পর্যন্ত দেশের ৩০টি সরকারি সংস্থার কাছে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিকÑ এই পাঁচ ব্যাংকের বকেয়া ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা। গত এক বছরে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যাংকগুলোর ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর পরিশোধ করতে পারছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

এদিকে দেশের সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিপুল অঙ্কের অর্থ আটকে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোয় লোকসানের পাহাড় জমবে। চলতি অর্থবছরে যেখানে এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা লোকসান প্রাক্কলন করা আছে, সেখানে আগামী এক অর্থবছরেই সেটি ৫ গুণ বেড়ে প্রায় সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াচ্ছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় ৩০টি করপোরেশনের মধ্যে ১৮টির কাছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ ৩৯ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। এই ঋণের সাড়ে ৯৬ শতাংশই রয়েছে সাতটি প্রতিষ্ঠানের কাছে। এর মধ্যে ১৮৪ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হচ্ছে না। উল্টো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতি বছরই লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। ফলে বছরের পর বছর ব্যাংকের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। সময়মতো ঋণ শোধ করতে না পারায় গুনতে হচ্ছে বাড়তি সুদ। এমনকি কারও কারও নাম উঠছে খেলাপির খাতায়। অন্যদিকে যথাসময়ে ঋণের টাকা ফেরত না আসায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যায় পড়ছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় করপোরেশনগুলোর দায়দেনা ও লোকসানের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কখনোই এই বিষয়টিকে জোরালোভাবে দেখা হয়নি। তা অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন, এসব সংস্থার লোকসান অব্যাহতভাবে বাড়ছে। তারা ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করে না। এদের রাজস্ব দায়বদ্ধতা লাখ লাখ কোটি টাকা। এসব সংস্থাকে কীভাবে লাভজনক করা যায়; সে বিষয়ে বাজেটে দিকনির্দেশনা থাকা উচিত। তিনি বলেন, এ খাতে এত বেশি লোকসান না দিলে টাকাগুলো উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করা যেত।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে সরকারি করপোরেশনগুলোর ঋণ ব্যবহারে বড় ধরনের দুর্নীতি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত রাজনৈতিক প্রভাব, কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় ট্রেড ইউনিয়নের হস্তক্ষেপ, অধিক জনবল নিয়োগ, ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে ব্যর্থতা এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়। তবে তাদের মতে, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেও এখানে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। ফলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। 

পাঁচ ব্যাংকে ঋণ আছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ঋণের ৯৬ শতাংশই সাত প্রতিষ্ঠানের

অর্থ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের সূত্র মতে, অব্যবস্থাপনা, মনিটরিংয়ের অভাব, অদক্ষ ও অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ, দুর্নীতি, জবাবদিহিতা ও সুশাসনের অভাবে সরকারি সংস্থাগুলোর লোকসানের পরিমাণ কমানো যাচ্ছে না। বছরের পর বছর এসব সংস্থার জন্য রাখতে হচ্ছে বিশেষ বরাদ্দ। ফলে প্রতিবছর বাড়ছে ভর্তুকির পরিমাণ, চাপ পড়ছে বার্ষিক বাজেটে। পাশাপাশি এসব সংস্থার কাছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ রয়েছে কয়েকশ’ হাজার কোটি টাকা। ওই ঋণের তথ্য মেলানোই এখন কঠিন। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে সরকারি শিল্প করপোরেশন লোকসান দেয়। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব, ট্রেড ইউনিয়নের অযাচিত হস্তক্ষেপ, অধিক জনবল নিয়োগ, ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, পেশাদারিত্বের অভাব, মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে ব্যর্থতা ও অধিক উৎপাদন ব্যয় উল্লেখযোগ্য। এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, কোম্পানি লাভজনক হওয়ার জন্য উন্নত ব্যবস্থাপনা দরকার। আর ব্যবস্থাপনায় সংকট থাকলে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পরও কোম্পানি লাভজনক হতে পারবে না। তিনি বলেন, কোনো কোম্পানির হিসাবেও ঝামেলা রয়েছে। কিন্তু কোম্পানি লিস্টেড হলে তার হিসাব স্বচ্ছ থাকে। অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণ বলছে, এ ধরনের করপোরেশনের ব্যাপারে মানুষের এ ধরনের আস্থা নেই। ফলে আস্থা পুনরুদ্ধার ছাড়া কোম্পানি লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা কম। সংস্থাটি মনে করছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান লাভজনক করতে সরকারের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিচালনা করতে হবে।

চলতি অর্থবছর অন্তত ১২টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান লোকসানে রয়েছে। অর্থবছরের এ পর্যন্ত তাদের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ৮ প্রতিষ্ঠান লোকসানে ছিল। ওই সময় পর্যন্ত তাদের লোকসানের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। এ সময় সর্বোচ্চ ৬ হাজার ১১৮ কোটি টাকা লোকসানে রয়েছে বিপিডিবি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৩৩ কোটি টাকা লোকসানে টিসিবি। তৃতীয় সর্বোচ্চ বিআরইবি লোকসান ৪ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। আর বিসিআইসির লোকসান ১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। এছাড়া বিএসএফআইসি ৫৭২ কোটি, বিজেএমসি ২২৫ কোটি, বিআরটিসি ১১৭ কোটি, আরডিএ ৯৭ কোটি, বিআইডব্লিউটিএ ৭২ কোটি, বিআইডবউটিসি ৬০ কোটি টাকা, বিএফডিসি ২১ কোটি এবং বিটিএমসির ১৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের বাজারে ব্যবসা করে যেখানে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো লাভ করছে। সেখানে একই ধরনের ব্যবসা করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো দিনের পর দিন লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের লোকসান অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। সীমাহীন দুর্নীতি, সঠিক নীতি-কৌশলের অভাব এবং উদাসীনতার কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলোর এ দুরবস্থা হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসানের জন্য দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং সামর্থ্য অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন না করাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা।


সম্প্রতি শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন জাতীয় সংসদকে জানিয়েছেন, দেশে সরকারি মালিকানাধীন ২৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান লোকসানে চলছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) অধীন চারটি, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন ১৫টি এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীন ৯টি প্রতিষ্ঠান। সংসদে দেওয়া শিল্পমন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী, বিএসইসির অধীন গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত এটলাস বাংলাদেশ লিমিটেড, বাংলাদেশ ব্লেড ফ্যাক্টরি লিমিটেড ও ন্যাশনাল টিউবস লিমিটেড এবং ঢাকার তেজগাঁওয়ে ইস্টার্ন টিউবস লিমিটেড লোকসানে চলছে। বিএসএফআইসির নিয়ন্ত্রণাধীন ১৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫টিই লোকসানি হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর ধরে লোকসান করে আসছে। এক সময় যখন প্রতিযোগী ছিল না, তখন এসব প্রতিষ্ঠান মুনাফা করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটা বড় ধরনের রিভিউ বা পরিবর্তন আনা দরকার। কোনটা কোন পদ্ধতিতে রাখলে ভালো হবে, এ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার সময় এসেছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দিতে হবে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে শেয়ার অফলোড করা যেতে পারে। যাতে সরকারের পাশাপাশি জনগণের মালিকানা সৃষ্টি হয়। পরিচালনা পর্ষদে শেয়ারের ভিত্তিতে জনগণের প্রতিনিধিও থাকবে। শুধু সরকারি কর্মকর্তারাই প্রতিষ্ঠান চালালে হবে না। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে রাখার দরকার নেই। এগুলো বেসরকারি খাতে দিয়ে দেয়া যেতে পারে। এসব পরিবর্তনের এখন সময় এসেছে।

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ