আন্দোলনে সহিংসতা
ছোট-বড় সবাই ভীত ও শঙ্কিত
প্রকাশিত: আগস্ট ০৩, ২০২৪, ০৬:৪০ বিকাল
দেশে ঘটে যাওয়া সহিংসতা প্রত্যক্ষ করছে সব বয়সের মানুষ। কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় বহু তাজা প্রাণ ঝরছে। এখনো অনেক মানুষ আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কষ্ট পাচ্ছে। হঠাৎ গুলির শব্দ, সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ, টিয়ার শেলের ধোঁয়া, বড় বড় ধারালো অস্ত্রে পসরা দেখছে দেশের মানুষ। এত মারামারি, রক্ত আর বীভৎসতা দেখে শিশু থেকে শুরু করে বড়রাও ভীত-শঙ্কিত হয়ে পড়ছে। টিভি-পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই দেখেছে সহিংসতার দৃশ্য।
গত ২০ জুলাই সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় সংঘর্ষের মাঝে পড়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন সেলুনকর্মী রাকিব হোসেন। প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় পরে তাকে জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান বা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বুলেটবিদ্ধ ক্ষতস্থানে সংক্রমণ ধরায় চিকিৎসকরা রাকিবের বাম পা কেটে ফেলেছেন। কিন্তু ১৯ বছর বয়সী রাকিব পা হারানোর কষ্ট কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। আত্মীয়স্বজন কাউকে দেখলেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছেন, আমি কি আর কখনোই দুই পায়ে ভর করে হাঁটতে পারব না? আমাকে সারা জীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে!
রাকিবের বাবা কবির হোসেন বলেন, ঘটনার পর থেকে ছেলে ঘুমের মধ্যেও ভয়ে আঁতকে ওঠে। বিচ্ছিন্ন পা দেখে প্রায়ই পাগলের মতো কাঁদছে। চোখের সামনে ছেলের পা নেই দেখে পরিবারের সবাই মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে।
উত্তরার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, সংঘর্ষের সময় টানা দুই দিন কেউ বাসা থেকে বের হতে পারিনি। ছেলেমেয়েদেরও বাইরে বের হতে দিইনি। চারপাশে গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে ছেলেমেয়েরাও ভীত ছিল। পরিস্থিতি এত ভয়াবহ ছিল যে, সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা সেই ট্রমা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
মনোবিদরা বলছেন, দেশব্যাপী চলমান সহিংসতার পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে পরিবারের কাছ থেকে সান্নিধ্য বা সহায়তার সহযোগিতা পেলে বা চিকিৎসকের কাছে কাউন্সেলিং করানো হলে এমন পরিস্থিতি থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে পারে। অন্যথায় এর প্রভাব পড়তে পারে দীর্ঘমেয়াদি।
টিভি-পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই সহিংসতার দৃশ্য
এ ব্যাপারে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. তাজুল ইসলাম বলেন, গত কয়েকদিনে মানুষ কিছু ভয়াবহ দৃশ্য ও অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা শিশুর ওপর বেশি প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে শিশুদের কমিউনিটি, ইমোশনাল ও সোশ্যাল ডেভেলমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয়। এ আঘাত বা ট্রমা মস্তিষ্কে স্মৃতি হিসাবে থেকে যায় এবং পরে যখন তারা সামাজিক যোগাযোগ বা বিভন্ন মাধ্যমে এ ধরনের ভিডিও বা ঘটনার সম্মুখীন হয়, তখনও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভুক্তভোগীদের মানসিক ট্রমা কামাতে ব্যক্তি, পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন, এমনকি সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রকে সহযোগিতা-সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে।
স্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা বলছেন, শিশুর মনোজগৎ এবং বড়দের জগতের মধ্যে একটা বিপরীতমুখী চিন্তার প্রাচীর থাকে। এই প্রাচীর ভাঙার কাজ শিশুর নয়, বড়দেরই। বড়দের কাছে যে বিষয় অমূলক বা কাল্পনিক বলে মনে হয়, কোনো শিশুর কাছে সেটিই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে মনে হতে পারে। একই ভাবে বড়রা শিশুর যে অনিচ্ছা বা ভয়কে অমূলক বা হালকা বলে ভাবেন তা হয়তো শিশুর কাছে ভীতিকর হতে পারে। তাই ছোট্ট শিশুর কোনো ইচ্ছা, ভীতি অথবা আগ্রহকে যথাসম্ভব গুরুত্ব দিতে হবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে ১৯ জুলাই পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মাঝে সংঘর্ষের সময় ঘরেই ছিল ১০ বছরের মো. শাফাত সামির। দুপুরে বাইরে থেকে আসা টিয়ার শেলের ঝাঁজালো ধোঁয়া থেকে বাঁচতে নিজ কক্ষের জানালা বন্ধ করতে যায় সে। ওই সময় একটি গুলি এসে সামিরের চোখ দিয়ে ঢুকে মাথা ভেদ করে পাশে থাকা চাচা মশিউরকে আঘাত করে দেওয়ালে গিয়ে ঠেকে। ছোট্ট সামিরের রক্তে রঞ্জিত দেওয়ালের ক্ষতচিহ্ন এখনো বলে দিচ্ছে বুলেটের আঘাতের গতি কতটা তীব্র ছিল!
গত বুধবার রাতে রাজধানীর কাফরুলের হাউজিং স্টাফ কোয়ার্টারের ১৫ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয়তলায় সঙ্গে কথা হয় সামিরের পরিবারের। এ সময় নাতির পড়ার টেবিলে থাকা বই-খাতা, আইডি কার্ড ও খেলনাসামগ্রী দেখিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন সামিরের দাদি। তিনি বলেন, সামির মিরপুর-১৪ নম্বরে জামেউল উলুম মাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। নাতির স্বপ্ন ছিল বড় আলেম হবে, আমি মারা গেলে জানাজা পড়াবে। সারাক্ষণ ঘর আলোকিত করে থাকা সেই কলিজার টুকরা নাতিই আজ অন্ধকার কবরে শুয়ে আছে। এ কষ্ট আমি কেমন করে সইছি...! ওর মা-বাবাকে কীভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছি। আমাদের সবার মনে যে ক্ষত ও ঝড় বইছে, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে বোঝাতে পারব না। এ সময় আঁচলে চোখের পানি মুছতে থাকেন তিনি।
দেশে চলমান সহিংসতায় ৩২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। এত শিশুর মৃত্যুতে উদ্বেগ জানিয়ে ইউনিসেফের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক সঞ্জয় উইজেসেকেরা বলেছেন, সব সময় শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে হবে। এটা সবার দায়িত্ব। জুলাই মাসে আন্দোলনের সময় অন্তত ৩২ শিশু প্রাণ হারিয়েছেন বলে নিশ্চিত হয়েছে ইউনিসেফ। এছাড়া আরও অনেক শিশু আহত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অনেক শিশু আটক হয়েছে বলেও জানায় তারা। তিনি বলেন, সহিংসতা ও চলমান অস্থিরতার যে প্রভাব শিশুদের ওপর পড়ছে; তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, বাংলাদেশের স্বাক্ষর করা জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ এবং আটক করা হলে শিশুদের ওপর যে প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে গবেষণার ভিত্তিতে ইউনিসেফ শিশুদের যেকোনো ধরনের আটক বন্ধের আহ্বান জানায়।
দৈনিক সরোবর/ কেএমএএ