ঢাকা, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১

রেল: ভুল সিগন্যালে ঘটছে দুর্ঘটনা

নিউজ ডেস্ক

 প্রকাশিত: মে ০৯, ২০২৪, ০৮:০৩ রাত  

সারাদেশে নতুন নতুন রেললাইন নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হলেও যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি ও রেলের সিগন্যাল ব্যবস্থা ডিজিটাল করার ক্ষেত্রে তেমন কোনো নজর নেই কর্তৃপক্ষের। ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশে রেল চলে ব্রিটিশ আমলের অ্যানালগ বা ম্যানুয়ালি সিগন্যাল ব্যবস্থায়। 

নিরাপদ ভ্রমণে বাহন হিসেবে সবার পছন্দ ট্রেন। তবে বাংলাদেশে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা যুগের সঙ্গে এখনো তাল মেলাতে পারেনি। পুরনো সিগন্যাল পদ্ধতিতেই চলছে রেলওয়ের বেশিরভাগ স্টেশন। এতে যথাসময়ে বার্ত প্রেরণে ব্যাহত ঘটে। অধিকাংশ দুর্ঘটনা সিগন্যালের ভুলে কারণে ঘটে থাকে। ফলে ভুল সিগন্যালে ভুগছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সারাদেশের ৪৮৩টি স্টেশনের মধ্যে অর্ধেকই চলছে অ্যানালগ সিগন্যাল পদ্ধতিতে। এর মধ্যে ১৩০টি স্টেশনে নেই কোনো সিগন্যাল ব্যবস্থা। সিগন্যাল অমান্য কিংবা সিগন্যালের ভুলের কারণে হরহামেশা ঘটছে দুর্ঘটনা।
জানা গেছে, দেশে ৪৮৩টি রেলস্টেশন আছে। এর মধ্যে পাঁচ ধরনের সিগন্যাল ব্যবস্থা আছে ৩৫৩টিতে। ২২টি স্টেশনে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সর্বাধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা রিলে ইন্টারলকিং সিগন্যালিং। এছাড়া কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলকিং সিস্টেম (সিবিআই) ব্যবস্থা আছে ১১২টি স্টেশনে।  ২১৯টি স্টেশন চলছে পুরোনো সিগন্যাল ব্যবস্থায়। যার মধ্যে ১২২টি স্টেশনে লাল-সবুজ বাতি বা ইন্টারলকড কালার লাইট সিগন্যালিং ব্যবহার করা হয়। ২৫টি স্টেশনে সম্পূর্ণ ম্যানুয়ালি রেললাইন নির্ধারণ করা হয়।
 
এসব স্টেশনে ট্রেন প্রবেশের আগ মুহূর্তে স্টেশনমাস্টার ঠিক করেন, কোন লাইন দিয়ে ট্রেনটি যাবে। সেভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা ট্রেন যাওয়ার লাইনটি ঠিক করে দেন। এ পদ্ধতিকে বলা হয় নন-ইন্টারলকড মেকানিক্যাল সিগন্যালিং সিস্টেম। আর ১৩০টি স্টেশনে কোনো রকম সিগন্যালিং সুবিধা নেই। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের (সদর) বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী (ডিএসটিই) রুবাইয়াৎ শরীফ বলেন, রিলে ইন্টারলকিং সিগন্যালিং ও সিবিআইএ দুটি সিগন্যাল ব্যবস্থাই আধুনিক বলা যায়। ১১২টি স্টেশনকে কম্পিউটারাইজড করা হয়েছে। নতুন যে স্টেশনগুলা করা হবে সেগুলোতেও সিবিআই সিগন্যাল ব্যবহার করা হবে। এছাড়া যেসব স্টেশন পুরোনো সিগন্যালে চলছে সেগুলোও আধুনিক করা হবে। 

রেল সংশ্লিষ্টরা জানান, নামমাত্র স্বয়ংক্রিয় বা ডিজিটাল সিগন্যাল পয়েন্ট থাকলেও পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল রেলের অধিকাংশ সেকশনে এখনও চালু রয়েছে ব্রিটিশ আমলের ম্যানুয়ালি সিগন্যাল ব্যবস্থা। ত্রুটিপূর্ণ সিগন্যাল, ভুল সিগন্যাল বা সিগন্যাল অমান্য করা এবং রেলওয়ের চালক ও কর্মীদের অবহেলার কারণে প্রায়ই দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় বলে মনে করেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ত্রুটিপূর্ণ সিগন্যাল ব্যবস্থা দিয়ে দেশে প্রতিদিন তিন শতাধিক যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে দুর্ঘটনার ঝুঁঁকি নিয়ে। ফলে সিগন্যালের ভুলের কারণে হরহামেশা ঘটছে দুর্ঘটনা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, বর্তমানে রেলওয়েতে উন্নয়নের নামে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করা হলেও এগুলো সবই নতুন প্রকল্পের জন্য ব্যয় হচ্ছে। রেলের নিজস্ব অবকাঠামো উন্নয়ন বা রেললাইন, পুরাতন রেল ব্রিজ বা কালভার্ট মেরামত, পুরাতন সিগন্যালিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন দরকার। কিন্তু সেদিকে নজর না দিয়ে রেল একের পর এক নতুন প্রকল্প নিচ্ছে। দুর্ঘটনা রোধে রেলের সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিকায়নে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, অল্প কিছু স্টেশনে ম্যানুয়াল সিগন্যাল আছে। সেখানে হয়তো ট্রেন কম যাচ্ছে। ট্রেনে আধুনিকায়ন জরুরি। এজন্য সিগন্যালগুলোও কম্পিউটার-বেইজড করতে হবে। তিনি বলেন, কোনো ট্রেন সিগন্যাল ভায়োলেট (অমান্য) করলে তাকে যেন তাৎক্ষণিক বন্ধ করা যায় সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। স্টেশনগুলোতে ডিজিটাল সিগন্যাল সিস্টেম ব্যবহার করতে হবে।

রেলওয়ের সাবেক এক অতিরিক্ত মহাপরিচালক জানান, কয়েকটি কারণে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে থাকে। একটা কারণ  হলো সিগন্যাল ওভারসুট করা অর্থাৎ ট্রেনকে থামার সিগন্যাল দেওয়া হলেও না থেমে চলে যায়। আরেকটা কারণ ভুল সিগন্যাল। স্টেশন মাস্টার ভুল সিগন্যাল দিলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আবার অনেক সময় দেখা যায় সিগন্যাল দিয়েছে একরকম আর লাইন সেটিং করেছে অন্যরকম। এছাড়া পয়েন্ট সেট করে লক করতে হয়। অনেক সময় লক না করলেও কিন্তু ট্রেন চলে যায়। এ ধরনের অনেক গাফিলতির কারণে ট্রেনে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। এসব দুর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বলছে, রেলে সিগন্যাল ব্যবস্থা ত্রুটির কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

রেলের সিগন্যাল বিভাগে সবচেয়ে কম জনবলের কথা জানিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সাল থেকে সারা দেশে ১৬০টি নতুন ট্রেন চালু করেছে। বর্তমান সরকার রেলের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও নানা কারণে সিগন্যাল ব্যবস্থার উন্নয়ন উপেক্ষিত রয়েছে। পুরো সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা সম্ভব হয়নি। আবদুল্লাপুর-পার্বতীপুর, দর্শনা-খুলনা এবং আখাউড়া-সিলেটসহ অধিকাংশ সেকশনে ম্যানুয়ালি সিগন্যাল ব্যবস্থায় ট্রেন চালানো হয়। তবে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী সেকশনে সিবিআই ও সিটিসি সিগন্যাল ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ চলমান। এছাড়া আখাউড়া-ভৈরব সেকশনসহ পদ্মা সেতু লিংক লাইন স্থাপন প্রকল্পে আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ চলছে। তিনি জানান, জনবলের সংকটের কারণে একটি স্টেশন পরিচালনা করতে যেখানে গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন লোক প্রয়োজন; সেখানে অর্ধেক জনবল দিয়ে পরিচালনা করা হয়। রেলকে নিরাপদ বাহন নিশ্চিত করতে হলে দুর্ঘটনা রোধ করতে হবে এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ