ড্যাপের ইউটার্ন
রাজধানীতে ভবনের উচ্চতায় ছাড়
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৩, ০৭:৩২ বিকাল

রাজধানী ঢাকা মহানগরীতে আগামী তিন বছরের জন্য আবাসন প্রকল্পে ভবনের উচ্চতায় ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন শুধু তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা বাকি। স্বল্প সময়ের মধ্যেই সংশোধিত ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ হবে।
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আগে প্রশস্ত রাস্তা না থাকলেও ৮/১০ তলা ভবন করা যেত। কিন্তু গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়ার পর ড্যাপে সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অপ্রশস্ত রাস্তার ক্ষেত্রে ৪/৫ তলা ভবন নির্মাণের বিধান রাখা হয়। এতে জমির মালিক, হাউজিং প্রতিষ্ঠান, ডেভেলপারদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা বারবার বলে আসছিলেন, স্বল্প প্রশস্তের রাস্তার পাশের জমির মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সেই সঙ্গে আবাসন বা ডেভেলপার কোম্পানিগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে, বাড়বে ভাড়াও।
অন্যদিকে রাজউক বলেছিল, ঢাকার বাসযোগ্যতা ফেরাতে এটির কোনো বিকল্প নেই। প্রশস্ত রাস্তা না থাকলে এলাকাভেদে ভবনের উচ্চতা বৃদ্ধির সুযোগ নেই। তবে, সেই অবস্থান থেকে সরে আসছে রাজউক। প্রভাবশালী হাউজিং ও ডেভেলপারদের চাপে রাস্তার প্রশস্ততা সাপেক্ষে ভবনের উচ্চতা নির্ধারণের জায়গা থেকে সরে আসছে তারা।
রাজধানী ঢাকার সমস্যা কমিয়ে পরিকল্পিত শহর গড়ার লক্ষ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছিল বছরের আগস্টে। সেখানে রাস্তার প্রশস্ততা যতটুকু, ভবনের ব্যবহারযোগ্য স্পেসের পরিমাণও সেই অনুপাতে হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।
ভবনের উচ্চতা নির্ধারণে ড্যাপে যেসব শর্ত ছিল: ডিটেল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) অনুযায়ী, ঢাকায় ভবনের উচ্চতা নির্ধারিত হতো সংশ্লিষ্ট এলাকার নাগরিক সুবিধা ও সড়কের প্রশস্ততা অনুযায়ী। যেসব এলাকায় প্রশস্ত রাস্তা ও নাগরিক সুবিধা যেমন- পার্ক, উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুবিধা বেশি থাকবে, সেসব এলাকায় বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা যাবে। সেক্ষেত্রে ভবনের উচ্চতা নিয়ে বাধা থাকবে না।
অন্যদিকে, যেসব এলাকায় বা প্লটের সামনে প্রশস্ত রাস্তা নেই সেসব এলাকার ভবন নির্মাণে বিভিন্ন ধরনের শর্ত দেওয়া হয়েছিল ড্যাপে। সেখানে বলা হয়েছিল, পাঁচ কাঠার একটি জমির সামনে যদি প্রশস্ত রাস্তা না থাকে তাহলে সেখানে চারতলা ভবন নির্মাণের অনুমতি পাওয়া যাবে। আগে একই পরিমাণ জমিতে আটতলা ভবন নির্মাণের অনুমতি পাওয়া যেত।
ড্যাপে ১২ থেকে ১৬ ফুট পর্যন্ত রাস্তার পাশে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) ধরা হয়েছিল ১.৭৫, অর্থাৎ এমন প্রশস্ত রাস্তার পাশে পাঁচ কাঠার প্লটে পার্কিংসহ পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা যাবে। ৬ থেকে ৮ ফুট প্রশস্ত রাস্তার পাশে ফ্ল্যাটের এফএআর ধরা হয়েছে ১.২৫। ৮ থেকে ১২ ফুট প্রশস্তের রাস্তার এফএআর ১.৫, ১৬ থেকে ২০ ফুট প্রশস্ত রাস্তার এফএআর ২, ২০ ফুট রাস্তার এফএআর ২.৫, ৩০ ফুট রাস্তার এফএআর ৩, ৪০ থেকে ৬০ ফুট রাস্তার এফএআর ৩.৫ থেকে ৩.৭৫ ধরা হয়েছে।
সংশোধিত ড্যাপে ভবনের উচ্চতাসহ যেসব ছাড় দেওয়া হয়েছে: সংশোধিত ড্যাপের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আগামী তিন বছরের জন্য সরকারি ও রাজউক অনুমোদিত বেসরকারি আবাসন প্রকল্পগুলোতে ভবন নির্মাণে আগ্রহী আবেদনকারীকে প্রণোদনা হিসেবে অতিরিক্ত দশমিক ৫ এফএআর (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া অপরিকল্পিত এলাকার মধ্যে খিলক্ষেত, উত্তরখান, দক্ষিণখান, বাড্ডা, ডেমরা, রায়েরবাজার, কেরানীগঞ্জ ও সাভার এলাকাসহ অন্যান্য এলাকায় দশমিক ৫ এফএআর বাড়ানোর সুযোগ প্রস্তাব করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৬ বিঘা পর্যন্ত আয়তনের ব্লক ২০ শতাংশ আর ১৫ বিঘার আয়তনের ব্লকে ৩০ শতাংশ প্রণোদনা পাবেন জমি মালিকরা। এতে সংশোধিত ড্যাপে ভবনের উচ্চতা বাড়বে।
সংশোধিত ড্যাপে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) বাড়ানো হয়েছে। এতে করে ভবনের উচ্চতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে। যেমন- ঢাকার অপরিকল্পিত এলাকা চলতি ড্যাপ অনুযায়ী ১৬ ফুট প্রশস্ত রাস্তা থাকলে ছয়তলা উচ্চতার ভবনের অনুমতি মিলত। কিন্তু সংশোধিত ড্যাপ অনুযায়ী ১২ ফুট রাস্তা থাকলেই এখন আটতলা ভবন করার অনুমতি দেবে রাজউক।
অন্যদিকে, ঢাকার পরিকল্পিত এলাকাগুলোতে সর্বনিম্ন ২৫ ফুট রাস্তা আছে সেখানে পাঁচ কাঠার আয়তনের প্লটে নয়তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের অনুমতি মিলত বর্তমান ড্যাপ অনুযায়ী। কিন্তু সংশোধিত ড্যাপে এখন ১০তলা পর্যন্ত করার অনুমতির বিধান যুক্ত হতে যাচ্ছে। সেখানে ৬০ ফুট রাস্তা থাকলে ১২তলা পর্যন্ত ভবন করার অনুমতি পাবেন জমির মালিকরা। সেই সঙ্গে ব্লকভিত্তিক আবাসনকে উৎসাহিত করা হয়েছে, সেখানেও বাড়ানো হয়েছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা।
বছর ঘুরতেই ড্যাপ সংশোধন: ১৯৯২ সালে সরকারের নেওয়া মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৯৫ সালে ঢাকা মহানগরী উন্নয়ন পরিকল্পনা- ডিএমডিপি করা হয়। পরে ১৯৯৬ সালে ড্যাপ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১০ সালের ২২ জুলাই গেজেট আকারে ড্যাপ প্রকাশ করা হয়। এরপর ২০১৩ সালে আবার ড্যাপ রিভিউ শুরু হয়। ২০১৫ সালে প্রথম ড্যাপের মেয়াদকাল শেষ হয়। পরে সময় বাড়িয়ে নগর উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে রাজউক। এরপর নতুন ড্যাপের মেয়াদ ধরা হয় ২০ বছর। সর্বশেষ ২০২২ সাল থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত সময়ের জন্য নতুন করে ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু বছর ঘুরতেই সংশোধন হতে যাচ্ছে আলোচিত ডিটেল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)।
জানা গেছে, গত ১২ জুলাই ড্যাপ সংশোধনের একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করা হয়। সেখানে ১১টি প্রস্তাব উল্লেখ করা হয়। এরপর ২০ জুলাই ওই প্রস্তাব স্বাক্ষর করা হয়। বর্তমানে সংশোধিত ড্যাপ প্রজ্ঞাপনের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।
বর্তমানে সংশোধিত ড্যাপে যা আছে: বর্তমান ড্যাপে আছে ভূমি পুনর্বিন্যাস, উন্নয়নস্বত্ব, প্রতিস্থাপন পন্থা, ভূমি পুনঃউন্নয়ন, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, উন্নতিসাধন ফি, স্কুল জোনিং ও ডেনসিটি জোনিং। রাজউকের অন্তর্ভুক্ত এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে মোট ৪৬৮টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। সেখানে ঢাকাসহ আশপাশের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার দুই হাজার ১৯৮ কিলোমিটার জলাধার সিএস রেকর্ড অনুযায়ী উদ্ধার করে সচলের সুপারিশ করা আছে। একই সঙ্গে এসব এলাকাকে বিনোদন স্পটে পরিণত করারও সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, রাস্তার প্রশস্ততার ওপর নির্ভর করে এবং এলাকাভেদে ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করার যে বিধান ড্যাপে রাখা হয়েছিল এতে করে জমির মালিক, আবাসন কোম্পানি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। কারণ, এ বিধান অনুযায়ী আটতলার ভবন করতে হতো চারতলা। এতে ঢাকায় যেমন ফ্ল্যাটের দাম বাড়ত তেমনি বাড়ি ভাড়াও বেড়ে যেত। এমন নিয়মের কারণে রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো ও জমির মালিক উভয়পক্ষের ক্ষতি হতো। তবে, সংশোধিত ড্যাপে ভবনের উচ্চতা নির্ধারণে ছাড় দেওয়ার বিষয়টি সবপক্ষের জন্য ভালো হবে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, পরিকল্পিত নগর গড়া, নাগরিক সমস্যা কমিয়ে আনার বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে ড্যাপে। কিন্তু ড্যাপের সুন্দর দিকগুলোর চেয়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের স্বার্থের দিকটাই যেন এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ড্যাপ বাস্তবায়ন হওয়ার এক বছরের মধ্যে বাসযোগ্য নগরের পরিকল্পনাকে প্রাধান্য না দিয়ে ভবনের উচ্চতাকে গুরুত্ব দেওয়া ভালো দিক নয়। বাসযোগ্য ও পরিকল্পিত নগরের কথা না ভেবে আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপে শেষপর্যন্ত তাদের দাবিকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় ভালো ভালো অনেক দিক রয়েছে। সবমিলিয়ে ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে রাজউকের আরও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে ডিটেল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ড্যাপ বাস্তবায়ন হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, অংশীজন, নগর নিয়ে কাজ করা পেশাজীবী সংগঠন সবাই যেসব মতামত দিয়েছেন, সেসব মতামতকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এখানে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। অপরিকল্পিত ও পরিকল্পিত এলাকার রাস্তায় প্রশস্ততার ভিত্তিতে ফ্লোর এরিয়া রেশিও নির্ধারণ করা ছিল। এখন সংশোধিত ড্যাপে ক্যাটাগরি অনুযায়ী ফ্লোর বাড়ানোর রেশিওতে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। ফলে ক্যাটাগরি অনুযায়ী ফ্লোর বাড়ানো যাবে। এ ছাড়া সংশোধিত ড্যাপে ব্লকভিত্তিক আবাসনকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, প্রতি তিন বছর পরপর ড্যাপ রিভিউ করার সুযোগ আছে। আগামী রিভিউয়ের সময়ও প্রেক্ষাপট, নগর পরিকল্পনার সার্বিক দিক বিবেচনা করে ড্যাপ সংশোধনের সুযোগ থাকবে– বলেন আশরাফুল ইসলাম।
দৈনিক সরোবর/এএস