সব পণ্যের দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশ
বাজারের টাকা গিলে খাচ্ছে সিন্ডিকেট
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৩, ০৭:৩৭ বিকাল

বাংলাদেশে কিছুদিন পর পর কোনো না কোনো পণ্য সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ছে। কখনো মুরগি, পেঁয়াজ, আটা, ডাল, সয়াবিন তেল, কাঁচামরিচ, ডিম, এমনকি ডাব ও রোগীকে দেয়া স্যালাইনও বাদ যাচ্ছে না। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশির ভাগ পণ্যের দাম যখন বেড়ে চলেছে, তখন সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রী বলেছেন, পণ্যের দাম ওঠানামার পেছনে একটা সিন্ডিকেট সব সময় কাজ করে।
বাজার সিন্ডিকেটের কারণেই আজ ক্রেতার নাভিশ্বাস। এ সিন্ডিকেটই খেয়ে ফেলছে দেশের মানুষের বাজারের টাকা। দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি বা হাতে গোনা দুয়েকটি পণ্যের সরবরাহ সঙ্কটের কারণে ওইসব পণ্যের দাম বাড়ছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশ দাম বাড়ছে বাজার সিন্ডিকেটের কারণে। এ জন্য সরকারের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল, কৃষিমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রীসহ বেশ কয়েক মন্ত্রীও বিভিন্ন সময় বলেছেন, সিন্ডিকেটের কারণেই জিনিসপত্রের দাম আরও বেশি বেড়েছে। শুধু তা-ই নয়, এ সিন্ডিকেটকারীদের কঠোরভাবে দমন করারও ঘোষণা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘আমার মনে হয় বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের মতো এতটা মুনাফালোভী ব্যবসায়ী আর কোথাও নেই।’ তিনি বলেন, ‘বিগত কয়ে মাসে দেশের বাজারে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটর কারণে অধিকাংশ পণ্যের দাম রাতারাতি দ্বিগুণ-তিনগুণ বেড়েছে। বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি ও দেশে দুয়েকটি পণ্যের সরবরাহ সঙ্কটের কারণে যদি ২০ ভাগ দাম বাড়ে, বাকি ৮০ ভাগ দাম বাড়ানো হয়েছে সিন্ডিকেট করে। এখন কথা হচ্ছে এই সিন্ডিকেট কেন গড়ে উঠল, আর সিন্ডিকেট ভাঙবেই বা কে। এর জবাব হচ্ছে, সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে সরকারি সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার কারণে এবং কেবল সরকারই পারে এই সিন্ডিকেট ভাঙতে। কারণ সরকারের চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ আছে বলে আমি মনে করি না।’
জানা গেছে, বাজারে ডিম, আলু, পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচের ক্ষেত্রে যে দাম বাড়ল; এতেও ছিল অতিমুনাফা লোটার প্রবণতা। যদি তাই না হয়, তাহলে ভারত থেকে আমদানির খবরেই এত দ্রুত কেন নে মে গেল দাম। বাজারে সিন্ডিকেটে ডিমের দাম বেড়ে গেল অস্বাভাবিক। এর পেছনেও ছিল ডিম সিন্ডিকেটের হাত বড় করপোরেট কোম্পানি। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ‘১৫ দিনে পোল্ট্রি খাতের সিন্ডিকেট লুটে নিয়েছে ৫২০ কোটি টাকা এবং মাত্র ৫ দিনে ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীরা বাড়তি মুনাফা তুলেছে ১৫০ কোটি টাকা। সম্প্রতি কাঁচা মরিচের কেজি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় ঠেকেছিল। যেই ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আমদানি শুরু হলো অমনি দাম পড়ে গেল। সবজির, মাছের বাজারেও রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এখানে ফড়িয়া এবং পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়ায়। সব শেষ চলতি সপ্তাহে সিন্ডিকেট করে তরল দুধের লিটারে ৭ থেকে ১০ টাকা এবং গুঁড়া দুধে কেজিতে ৫০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হলো। এমনকি গাছের ডাব; তাও অসাধু বাজার সিন্ডিকেটের দখলে।
বাংলাদেশে বাজারব্যবস্থার প্রসঙ্গ উঠলে একইসাথে আলোচনায় আসে ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটি। সিন্ডিকেট বলতে একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মিলে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া বা নির্দিষ্ট স্বার্থ হাসিলকে বোঝানো হয়। এ কাজ ভালো কিংবা খারাপ দুটোই হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে সিন্ডিকেট বলতে মূলত ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট বোঝায় এবং এই শব্দটি নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার হয় আসছে। যেখানে এক দল ব্যবসায়ী বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে ইচ্ছামতো পণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে এবং দাম বাড়িয়ে অবৈধভাবে মুনাফা অর্জন করে।
ডিমের দাম আমরা ঠিক করতে পারি না। এটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেখে না : সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়
বাজার দেখভালকারী সরকারি একাধিক সংস্থার কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে এ সংস্থাগুলোকে একত্রিত করে সমন্বিত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি এখনো। সংস্থাগুলো তাদের মনিটরিং রিপোর্ট আলাদাভাবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে থাকে। কিন্তু মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা না নিলে সে ক্ষেত্রে অধীন সংস্থাগুলোর বা কর্মকর্তাদের ইচ্ছা থাকলেও কিছু করার থাকে না। তারা উদাহরণ টেনে প্রশ্ন তোলেন- সম্প্রতি সময়ে ডিম, চিনি ও পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের যে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা কি নিয়েছে?
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির প্রভাবের চেয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণেই বাজারে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের রেকর্ড দাম বেড়েছে, যা দেশের ইতিহাসে আগে কখনও দেখা যায়নি। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব নেওয়ার দরকার ছিল। এক মন্ত্রণালয় আরেক মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলছে। কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। তার মানে হলো ব্যবসায়ীরা যা পারে মুনাফা করুক। ফলে ব্যবসায়ীরা বুঝে গেছেন, সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না। কারসাজি করে সবাই পার পেয়ে যাচ্ছে বলেই দাম বাড়িয়ে ক্রেতার পকেট কাটার একটা প্রতিযোগিতায় নেমেছে সবাই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার বা সরকারি দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর যথাযথ তদারকির অভাবে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী বাজার সিন্ডিকেট এবং তাদের ব্যর্থতার কারণেই সিন্ডিকেটকারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও ইউএনডিপির কান্ট্রি গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, আমাদের দেশে ব্যবসার একটা লেভেল প্লে ফল করা হয় না। একজন ব্যবসায়ী তিনি সব ধরণের ব্যবসার সাথে জড়িত। আলু, পটলের ব্যবসায়ী; টাকা আছে তিনি আবার জাহাজের ব্যবসা করেন। যার জন্য বড় বড় করপোরেট গ্রুপ কোম্পানীগুলো বাজার সিন্ডিকেট করতে সুবিধা পায়; এটার নিয়ন্ত্রণ দরকার। সুযোগ বুঝে বাজার অসাধু চক্র সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ি দেয়। মনে হচ্ছে, চক্রটিকে ভোক্তার পকেট কাটতে সুযোগ করে দেয় সরকারের নীতিনির্ধারকরা। আবার অসাধুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই ।
অসাধু সিন্ডিকেট শনাক্তে বাজার তদারকিতে নামানো হয় গোয়েন্দা সদস্যদের। নামানো হয় পুলিশও। কিছুই কাজে দিচ্ছে না। তথ্য মতে, দেশে ভোগ্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। বাজারে পণ্যের নির্ধারিত দামের বিষয়টি তদারকি করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। এ ছাড়া কৃষি অধিদপ্তর ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও বাজার নিয়ন্ত্রণে নজরদারি করে থাকে। তবে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, পণ্যের দাম আমরা ঠিক করতে পারি না। এটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেখে না; এটা তাদের কাজ নয়। আমাদের জানার দরকার- পণ্য বা ডাল, পেঁয়াজ ও ডিমের সঠিক দামটা কত? সেটা জানতে মন্ত্রণালয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে মাঠে নামতে পারে। তবে আমরা সিন্ডিকেট বন্ধ করে দিলাম, তারা (সিন্ডিকেট চক্র) বাজারে পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিল; তখন ভোক্তারা পণ্য পেল না। এ জন্য আমাদের সবদিকে খেয়াল রাখতে হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করতে শুধুমাত্র আইন দিয়ে হবে না মূল্যবোধও লাগবে জানিয়ে তিনি বলেন, শুধু আইন দিয়ে নয় মূল্যবোধেরও প্রয়োজন আছে। একই সঙ্গে পণ্যের সাপ্লাই আর ডিমান্ড ঠিক রাখতে হবে।
এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জানান, বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রচলিত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনটি সংশোধন ও সময়োপযোগী করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ভোক্তা অধিদপ্তরকে বিচারিক ক্ষমতা দেয়া গেলে ভালো হয়। সিন্ডিকেট, অবৈধ মজুদদার, কালোবাজারিদের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিদপ্তর তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সিন্ডিকেট সব সময় সুযোগ খোঁজে বাজারে কারসাজি করে মূল্যবৃদ্ধির জন্য, আর আমরাও সক্রিয় এসব অবৈধ কারবারিদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে। ডিম, ব্রয়লার মুরগি ও পেঁয়াজের মতো পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারসাজির বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি।
দৈনিক সরোবর/কেএমএএ