বিসিএস ও চাকরিতে প্রবেশের বয়স নিয়ে নতুন বিতর্ক
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২৪, ০৯:০৪ রাত
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২ বছর এবং বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় একজন প্রার্থী তিনবারের বেশি অবতীর্ণ হতে পারবেন না- অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ এই সিদ্ধান্ত জানানোর পর থেকে এ নিয়ে দেশ জুড়ে আলোচনা চলছে। এটি নিয়ে এত বেশি চর্চা হচ্ছে যে এই মুহূর্তে ফেসবুকের বহুল আলোচিত শব্দ হলো–বিসিএস।
অনেকে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন, অনেকে আবার তিরষ্কারও করছেন।তিনবার অবতীর্ণ হতে পারার বিষয়টি নিয়ে কিছু ধোঁয়াশাও সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই বলছেন, এখানে ‘অবতীর্ণ’ শব্দটি দ্বারা আসলে কী বোঝানো হচ্ছে, সেটি অস্পষ্ট। এর অর্থ যদি এই হয় যে একজন প্রার্থী তিনবারের বেশি বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবন না, তাহলে যারা ইতোমধ্যে তিনবার পরীক্ষা দিয়েছেন এবং নতুন নির্ধারিত বয়সসীমা নিয়ে আরও পরীক্ষা দিতে পারবেন, তাদের কী হবে? অথবা, বিসিএস পরীক্ষা দিতে পারার সুযোগের সংখ্যা সীমিত করার আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, করলেও সেটা কত হওয়া উচিৎ ছিল; এ নিয়েও নানাপ্রকার বিতর্ক আছে।
মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত, আন্দোলনকারীদের হতাশা: মূলত, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ও অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধির জন্য সরকারি চাকরি প্রত্যাশীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তা আরও জোরদার হয়েছে।
তাদের দাবির প্রেক্ষিতেই বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকে ‘সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্ব-শাসিত সংস্থাসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা নির্ধারণ অধ্যাদেশ, ২০২৪’ এর খসড়ার নীতিগত চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়।
এই অধ্যাদেশের আলোকে ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’-এর ধারা ৫৯-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বয়স, যোগ্যতা ও সরাসরি নিয়োগের জন্য পরীক্ষা) বিধিমালা, ২০১৪’ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ‘একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ তিন বার অবতীর্ণ হতে পারবে’- এমন বিধি সংযোজন করতে পারবে।
সেইসাথে, বিসিএস-এর সকল ক্যাডারের চাকরিতে ও বিসিএস-এর আওতা বহির্ভূত সকল চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২ বছর হবে। তবে স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং প্রতিরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজস্ব নিয়োগ বিধিমালা অনুসরণ করতে পারবে।
সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা সর্বোচ্চ ৩২ বছর করার বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন এ ইস্যুতে আন্দোলন করে আসা শিক্ষার্থীরা।
বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫ প্রত্যাশী সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ'র ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করেন তারা। তাদের অভিযোগ, সরকার জনপ্রশাসন সংস্কার কমিটির সুপারিশ আমলে নেয়নি।
উপদেষ্টা পরিষদকে সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি তারা আবারও কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন। তাদের দাবি, চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর করা হোক এবং অন্তত আটবার বিসিএসে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হোক। এই দাবিতে শুক্রবারও রাস্তায় নেমে এসেছেন সরকারি চাকরি প্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণলায়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বৃহস্পতিবার বলেছেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হলেও এই সিদ্ধান্ত আর পরিবর্তন হবে না। এমনকি, বিসিএস পরীক্ষায় সর্বোচ্চ তিনবার অংশগ্রহণের সুযোগেও কোনও পরিবর্তন আসছে না।
বিসিএস পরীক্ষা ‘তিনবার মানে তিনবারই’ দিতে পারবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগে যারা পরীক্ষা দিয়েছেন তাদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত, এটা একটা লিগ্যাল বিষয়। যখন অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত হবে তখন এই আইনি বিষয়গুলো স্পষ্ট করা হবে। আজ খালি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যে তিনবার বিসিএস দেয়াদের কী হবে?: এই প্রশ্নের উত্তর কী হবে, সে বিষয়ে রিজওয়ানা হাসান সুষ্পষ্ট করে কিছু বলেননি। শুক্রবার তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলো বিবিসি বাংলা। কিন্তু মিজ হাসানকে পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেমের সাথে কথা হয় বিবিসি বাংলা’র। এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা আমার কাছেও স্পষ্ট না। আপনি যেটা দেখেছেন, আমিও সেটাই দেখেছি। সেখানে কিছু নাই, আমার কাছে সেটাই মনে হয়েছে। তবে প্রজ্ঞাপনের পর বিবরণ থাকবে। ব্যাখ্যাগুলো তখন আসবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানের সাথে যোগাযোগ হলে তিনি এ বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রপরিষদ সচিবের সাথে কথা বলতে বলেছেন। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
যারা ইতোমধ্যে তিনবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছেন তাদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে, সে বিষয়ে একটা ব্যাখ্যা দেন সরকারের সাবেক সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান।
তিনি বলেন, এখানে এটা ক্লিয়ারলি বলা হয়নি, এটা সত্য। আমাদের সরকারি সার্কুলারে অস্পষ্টতা থাকে। সেটার আবার পরে ব্যাখ্যা দিতে হয়। এখানেও ব্যাখ্যা দেওয়া উচিৎ এবং সেটা নিশ্চয়ই আসবে। তবে প্রার্থীদের দ্বিধা থাকতে পারে; কিন্তু আমরা যেহেতু সরকারি চাকরি করেছি, তাই আমরা ভাষাটা বুঝি। সরকারের কোনও আদেশ বা প্রজ্ঞাপন যেদিন প্রণীত হয়, সেদিন থেকে আইন কার্যকর হয়।
অর্থাৎ, যারা ইতোমধ্যে তিন-চারটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ফেলেছে এবং এখনও কয়েক বছর বয়স আছে, তাদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য করা যাবে না, এটা হয় না সাধারণত।
তাছাড়া, উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তে বলা আছে যে সর্বোচ্চ তিনবার পরীক্ষা দিতে পারবে; কিন্তু সেখানে কোথাও বলা নাই যে যারা পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছে, তারাও পারবে না–তিনি ব্যাখ্যা করেন। ‘প্রজ্ঞাপনের পর এটি কার্যকর হবে। এর বাইরে কোনোকিছু হওয়ার সুযোগ নাই’-তিনি যোগ করেন।
আন্দোলনকারীদের দাবি মানা উচিৎ কি না: এখন, চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২ বছরের পক্ষে আন্দোলনকারীরা সমর্থন না দিলেও অনেকেই এ বিষয়টিকে ভালো সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান নিজেও এর একটি ব্যাখ্যা গতকাল দিয়েছেন। তিনি বলেন, যে যুক্তিগুলো দিয়ে বলা হচ্ছে সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা ৩৫ করতে হবে। যেমন- করোনা, আন্দোলন; সেগুলো আসলে অস্থায়ী কারণ। এগুলো স্থায়ী কোনো কারণ না, যার জন্য আমাকে বড় কোনো পরিবর্তনে যেতে হবে। আমরা দেখেছি, যেহেতু বিসিএসের প্রতি অনেকের আগ্রহ থাকে, বয়স অনেক দূর বাড়িয়ে দিলে একজনই বারবার এখানে পরীক্ষা দেয়, অন্যদের জন্য সুযোগ সীমিত হয়ে যেতে পারে। এটার কিছু অর্থনৈতিক বিষয়ও আছে। এগুলো হচ্ছে স্থায়ী বিষয়। এগুলো চিন্তা করে বয়স ৩২ রাখাটা সমীচীন।
আবু আলম শহীদ খানও এ প্রসঙ্গে বলেন, চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ৩৫ বছর করা করা হলে সব ধরনের পরীক্ষা ও আইনি প্রক্রিয়া শেষে চাকরিতে যোগদান করতে আরও দুই-তিন বছর লাগবে।
‘এই বয়স চাকরিতে প্রবেশের বয়স না। যিনি ২৪ বছর বয়সে যোগদান করবেন, তিনি ততদিনে অনেক দূর এগিয়ে যাবেন। তখন ছোটদের সাথে চাকরি করাটা দেরিতে চাকরিতে যোগদানকারীদের জন্য মানসিক সমস্যার তৈরি করতে পারে। তাই, দুই বছর বাড়ানো ঠিক আছে।’
তবে সাবেক এই সচিবের মতে, তিনবারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলতে পারে। ভারতেও ছয়বার দিতে পারে। আমাদের ক্ষেত্রে তিনবার…এটা কম কি না, এটা ভেবে দেখার সুযোগ আছে।
বাংলাদেশে ৪০-৪২ লক্ষ শিক্ষিত বেকার আছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন যে এভাবে সরকারি চাকরির আশায় বসে থাকলে পরবর্তীতে অন্য কোনও চাকরিই হবে না।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়স যদি ৩৫ করা হয় তাহলে তরুণদের মেধাকে কাজে লাগানো যাবে না। তরুণরা যে অনেক দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে সেটা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন?
মজুমদার এখন সরকারের একজন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। নতুন এই সিদ্ধান্তের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর, আর অবসরে যাওয়ার সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫৯ বছর ছিল। তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীদের ক্ষেত্রে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ ও অবসরে যাওয়ার বয়স ৬০ বছর ছিল।
আগেও বাড়ানো হয়েছে বয়স: আগে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ বছর ও অবসরের বয়স ছিল ৫৭ বছর। কিন্তু ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয় যদিও সেবার অবসরের বয়সসীমা আর বাড়ানো হয়নি। এরপর ২০১১ সালে অবসরের বয়স বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হয়। ওই সময় অবসরের বয়স বাড়ানোর পরের বছর ফের চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করে চাকরিপ্রত্যাশীরা। কিন্তু তৎকালীন সরকার তাতে সাড়া দেয়নি।
২০১৯ সালেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করা প্রসঙ্গে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি তখন বলেছিলেন যে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করা হলে ‘করুণ অবস্থা হবে। তার যুক্তি ছিল, ৩৫ বছরের পর চাকরির পরীক্ষা দিলে রেজাল্ট, ট্রেনিং শেষ করে যোগ দিতে দিতে ৩৭ বছর লাগে। সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা
দৈনিক সরোবর/এমই