ঢাকা, রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১

বিবিসি বাংলা’র প্রতিবেদন

সরকার কোটা আন্দোলনকারীদের 'প্রতিপক্ষ' বানিয়েছে?

সরোবর  ডেস্ক

 প্রকাশিত: জুলাই ১৭, ২০২৪, ০৬:৪৯ বিকাল  

কোটা বিরোধীদের অবরোধের কারণে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের বড় শহরগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে অনেকটা আকস্মিকভাবে। সংঘাতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত ছয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। কোনো আন্দোলনকে কেন্দ্র করে একদিনে এতো জনের মৃত্যু ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যায়নি। ২০১৮ সালের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের পর থেকে গত প্রায় ছয় বছরে এতো বড় আকারের বিক্ষোভের মুখোমুখি সরকার আর হয়নি। সরকার বিচলিত?: এই আন্দোলন সরকারকে ‘বিচলিত’ করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরিন বলছিলেন, শুধু এই আন্দোলন নয়, যে কোনো আন্দোলনকে সরকার মনে করে ঠেকাতে হবে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন বিষয়টিকে ‘সরকার বিরোধী আন্দোলন’ হিসেবে বিবেচনা করছে। বিষয়টিকে তারা শুধুই কোটা সংস্কার আন্দোলন হিসেবে দেখছে না।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি বেশ পরিষ্কার করেই বলেছেন। তিনি বলেন, আমরা শুরু থেকে বলে আসছি এই আন্দোলন হচ্ছে কোটা বিরোধিতার নামে সরকার বিরোধী আন্দোলন। আন্দোলনের ‘নেতৃত্ব’ নিয়েছেন বিএনপি নেতা তারেক রহমান। তার দল বিএনপি প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছে। একটা অরাজনৈতিক ইস্যুকে সমর্থন দিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দেওয়ার চক্রান্ত তারা করছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন,বিএনপির বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ আনা হয়, তাহলে তো স্পষ্টতই বোঝা যায় বিএনপি'র গ্রহণযোগ্যতা আছে। সরকার মুখে যা কিছুই বলুক না কেন বাংলাদেশের বর্তমান অন্যায় বাস্তবতা নতুন প্রজন্ম স্বীকার করতে রাজি নয়। এবং অতি দ্রুত সময়ে এই আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে তাদের সার্বিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে সরকার কেন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করছে? আন্দোলনকারীদের কেন প্রতিপক্ষ বানিয়েছে ক্ষমতাসীনরা?

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এই আন্দোলন যাতে সরকারকে রাজনৈতিকভাবে ‘নড়বড়ে’ করতে না পারে সেজন্য তারা বেশ সতর্ক। এর আগে ২০১৮ সালে কোটা বিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের এক পর্যায়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেছে। তখনও ক্ষমতাসীনরা আন্দোলনকারীদের ‘প্রতিপক্ষ’ বানিয়েছিল। ২০২৪ সালের কোটা বিরোধী আন্দোলনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলেও সরকারের দিক থেকে কঠোর মনোভাব দেখা যায়নি। আন্দোলনকারীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক মহাসড়ক অবরোধ করলেও পুলিশ তাতে বাধা দেয়নি।

পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে থাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর থেকে ফিরে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে।

কোটা বিরোধী এই আন্দোলনকে সরকার যে পছন্দ করছে না সেটি পরিষ্কার হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায়। এরপর থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র-সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তৎপর হতে শুরু করে।

আন্দোলন বাড়তে দিতে চায় না?: সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও পুলিশের দিক থেকে আন্দোলনকারীদের সতর্ক করে নানা বক্তব্য আসলেও কোটা-বিরোধী আন্দোলনকারীরাও ছিল তাদের অবস্থানে অনড়। তখন থেকেই ইঙ্গিত মিলছিল যে পরিস্থিতি সহিংস হয়ে উঠতে পারে।

অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন মনে করেন, এই কোটা বিরোধী আন্দোলন বিভিন্ন ক্ষেত্রে তরুণ সমাজের ‘পুঞ্জিভূত ক্ষোভের’ বহিঃপ্রকাশ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের যে ক্ষোভ সেটি কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এজন্য সরকার থ্রেটেন ফিল করেছে (ভীত হয়েছে)।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এই আন্দোলনকে সরকার আর বাড়তে দিতে চায় না। আন্দোলন বেশি দিন গড়ালে সরকার রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হতে পারে বলে তাদের ধারণা।

সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বিরোধীদের ওপর হামলার পর থেকে আন্দোলন রক্তাক্ত হয়েছে। এজন্য ছাত্রলীগকে দোষারোপ করছে কোটা বিরোধীরা।
অনেকে মনে করেন, ছাত্রলীগের মাধ্যমে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের রাস্তা থেকে হঠিয়ে দিতে চেয়েছিল। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা দেখাতে চেয়েছিল যে রাস্তায় যে কোনো আন্দোলনকে মোকাবেলা করার ‘রাজনৈতিক সামর্থ্য’ তাদের রয়েছে।

তবে সরকারের মন্ত্রীরা এখনো বলছেন, আন্দোলনকারীরা প্রতিদিন যেভাবে বিক্ষোভ-অবরোধ করছে সেটি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার এখনো কঠোর হয়নি।

মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, সরকার এখনো বিষয়টি ধৈর্য্য সহকারে পর্যবেক্ষণ করছে। তারা যদি ধ্বংসাত্মক কাজে নেমে আসে তাহলে সরকার তার ভূমিকা পালন করবে। সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীদের উপর ছাত্রলীগের সহিংসতা করার করার যে অভিযোগ উঠেছে সেটিকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে রাজি নয় ক্ষমতাসীনরা।

মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ছাত্রলীগের ওপর সব ব্যাপারে দোষ চাপানো একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। সব দোষই যেন নন্দ ঘোষ ছাত্রলীগের।

ছাত্রলীগ দাবি করে, সোমবার তাদের ৫০০ নেতাকর্মী আহত হয়েছে।

'কেন প্রতিপক্ষ বানাতে চাচ্ছে': আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্তরা বলছেন, তাদের এই আন্দোলন পুরোপুরি ‘অরাজনৈতিক’ বিষয়। মেধার ভিত্তিতে যাতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হয় সেটিই তাদের চাওয়া। মঙ্গলবার ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা মিছিল ও অবরোধ করেছে। এ রকম একটি মিছিল ছিল ঢাকার তেজগাঁও এলাকায়।

মিছিলে অংশ নেয়া একজন শিক্ষার্থী বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমাদের সম্মানের কোনো অভাব নেই। সরকার কেন আমাদের প্রতিপক্ষ বানাতে চাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি না। এই আন্দোলনকে যারা সমন্বয় করছেন তারাও সহজে হাল ছাড়তে রাজি নয়।

মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে বলছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, এক দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা রাজপথ ছাড়বে না। এই আন্দোলন বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে সারাদেশে। আমাদের ভাইদের যে গুলি করে শহিদ করা হলো এর বিচার করতে হবে।

এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল রবিবার রাতে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, কোটা সুবিধা মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে নাতো রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?

এরপর থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমে আসে। তাদের দাবি হচ্ছে, ‘রাজাকারের’ সাথে তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী তাদের সম্মানে ‘আঘাত’ করেছেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সেখানে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিচ্ছেন – ‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার।’

যদিও আন্দোলনকারীদের দাবি হচ্ছে, তাদের স্লোগানের একটি খণ্ডিত অংশ ক্ষমতাসীনরা প্রচার করে তাদের ‘প্রতিপক্ষ’ বানিয়েছে।

মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের প্রশ্ন তোলেন, আন্দোলনকারীরা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বা দেশবাসীর পক্ষে না ভেবে রাজাকার ভাবলো কেন? তাদের তো কেউ রাজাকার বলেনি। প্রধানমন্ত্রী তো কোটা আন্দোলনের কাউকে উদ্দেশ্য করে রাজাকার শব্দটি ব্যবহার করেননি। এই আন্দোলনকারীদের একটা অংশ রাজাকারের পক্ষ অবলম্বন করছে এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার। এর পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে বিএনপি জামাত, এর পেছনে আছে তারেক রহমান। এই আত্মস্বীকৃত রাজাকার যারা নিজেদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে।

'গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর অপচেষ্টা': আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিভিন্ন ফেসবুক পেজ থেকে অপপ্রচার চালিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ‘উত্তেজিত’ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য বিএনপি ও জামাতের ছাত্র সংগঠন সক্রিয় আছে বলে উল্লেখ করেন আওয়ামী লীগ সাধারন সম্পাদক । তিনি বলেন, গুজব ও অপপ্রচার চালিয়ে গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে।

ওবায়দুল কাদেরের দাবি হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটিকে বিকৃত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের মানুষের মধ্যে ‘বিভ্রান্তির চেষ্টা’ করা হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সমর্থন দিতে দ্বিধা করেনি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক বিএনপি। মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সারা দেশের মানুষকে তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।

বিএনপির মিডিয়া সেলের ফেসবুক থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশ-অবরোধ সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, এই সরকার গতকাল (সোমবার) যা ঘটিয়েছে, তা বাংলাদেশে আমরা আগে কখনো দেখিনি।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আন্দোলনকারীদের হঠানোর জন্য সরকার কঠোর পথেই হাঁটবে বলে মনে হচ্ছে।

মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, সরকার ও আন্দোলনকারীরা এখন মুখোমুখি অবস্থানে। তথ্যসূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

দৈনিক সরোবর/এএস