ঢাকা, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১

দেশে জন্মালেও দেশি ফল নয়

সরোবর ডেস্ক

 প্রকাশিত: জুলাই ০৯, ২০২৪, ০৮:৩৯ রাত  

দেশে প্রায় ১৩০ রকমের ফল জন্মায়। এর মধ্যে প্রচলিত ও অপ্রচলিত প্রায় ৭২টি ফলের চাষাবাদ হয়। দুই দশক আগেও হতো ৫৬ প্রজাতির ফল চাষ। বাংলাদেশে মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের ফল বেশি পাওয়া যায়। খনার বচন-'বারো মাসে বারো ফল, না খেলে যায় রসাতল’।এই থেকেই ধারণা করা যায় বাংলাদেশের মানুষদের জন্য ফলের গুরুত্ব কতোটা।

এই অঞ্চলে দেশি ফল বলতেই প্রথমে যে নামগুলো আসে তা হলো আম, কাঁঠাল, জাম, লিচু, পেঁপে, পেয়ারা, বরই, আমড়া, সফেদা, আনারস, কলা, জাম্বুরা, চালতা, তরমুজ, জামরুল, জলপাই, লটকন, কামরাঙ্গাসহ আরো নানা ধরনের ফল। এসব ফল আমরা এতদিন দেশি ফল হিসেবেই জেনে এসেছি। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল দেশি ফল হিসেবে জানা এমন অনেক ফলই আছে যাদের প্রকৃত উৎপত্তি বাংলাদেশে বা আশেপাশে নয় বরং হাজার মাইল দূরের।

সে ক্ষেত্রে প্রকৃত দেশি ফল কোনগুলো সেটা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা তাদের গবেষণাধর্মী মতামত জানিয়েছেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. গোলাম রাব্বানীর মতে, অনাদিকাল ধরে যেসব ফল অনায়াসে এই দেশে বা আশেপাশের উপমহাদেশীয় অঞ্চলে জন্মেছে এবং ভালো ফলন দিয়েছে সেসব ফলকে দেশি ফল বলা যেতে পারে। দেশি ফলের বৈশিষ্ট্য হল তারা ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ুর সাথে খুব ভালোভাবে মানিয়ে যায়। উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ার কারণে এসব ফল স্বাদে, গন্ধে ও বর্ণে আকর্ষণীয় এবং বৈচিত্র্যময় হয়ে থাকে। এসব ফলের গাছে তেমন কোনো সার বা সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয় না। একরকম বিনা যত্নেই এসব ফল এ দেশের মাটিতে ভালো ফলে।

কৃষি তথ্য সার্ভিস জানিয়েছে, ঝড়-বাতাস কিংবা বন্যা খরাও সাধারণত দেশি ফলের গাছকে সহজে মারতে পারে না। কেননা এসব গাছের ব্যাপকভাবে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা রয়েছে, যা অনেক বিদেশি ফলের নেই। দেশি ফলের আর একটা সুবিধা হলো, এসব ফল বা ফল গাছে বিদেশি ফল গাছের মতো অত বেশি রোগ পোকার আক্রমণ হয় না। বিদেশি ফলের চাইতে দেশি ফলে পুষ্টিগুণও বেশি থাকে বলে পুষ্টিবিদরা জানিয়েছেন। সে অর্থে বাংলাদেশে প্রচলিত ফলগুলোর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ফলের উৎপত্তি এই অঞ্চলে হয়েছে। অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রচলিত ২৫টি ফলের উৎপত্তির বিষয়ে জানিয়েছেন। আম: কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, আম বাংলাদেশের প্রধান চাষযোগ্য ফল। মি. রাব্বানীর মতে এটি ভারতীয় উপমহাদেশীয় ফল। সে হিসেবে একে দেশি ফল হিসেবেই ধরা হয়। এর আদি নিবাস দক্ষিণ এশিয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফলটি ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় হিমালয় সংলগ্ন পাদদেশ, মিয়ানমার, বাংলাদেশের চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা, মালয় এবং ইন্দো-বার্মা অঞ্চল থেকে এসেছে।

প্রাচীন ভারতের বহুবিধ ধর্মীয়, সামাজিক ও প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে, প্রাচীন শিল্পকলায় আম, আমের মুকুল, পাতা ইত্যাদির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘দ্য ম্যাঙ্গো’ বই থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ পার্বত্য চট্টগ্রাম, উত্তর–পূর্ব ভারত ও মিয়ানমারে বুনো আমগাছের রেকর্ড পাওয়া গিয়েছে।

আবার কোন কোন ফলবিদদের মতে, আম এসেছে ইন্দো-চায়না অঞ্চল অর্থাৎ ভিয়েতনাম, চীন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ইন্দোনেশিয়া থেকে। এক সময় আম কেবল বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় ফলতো। তবে কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে বর্তমানে ৩০টিরও বেশি জেলায় আমের চাষ হচ্ছে। এটি মূলত গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালের ফল। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আমের ১২৭ জাত পাওয়া গেছে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- গোপালভোগ, ল্যাংড়া, হিমসাগর, ফজলি, খিরসাপাত, বারি আম, বাউ আম, ভাসতারা, লক্ষণভোগ, আম্রপালি, মিসরিভোগ, আশ্বীনা, চৌনা, কোহিতুর, মোহনভোগ, কিষাণভোগ, পুষা, মাধুরী, রুবি, মঞ্জিরা, সাবরী, রাতুল ইত্যাদি। কাঁঠাল: জাতিসংঘের খাদ্য বিষয়ক সংস্থা এফএও এর তথ্য মতে, বার্ষিক উৎপাদনের পরিপ্রেক্ষিতে, আমের পরে কাঁঠাল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফল, যা মোট ফল উৎপাদনের এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি। কাঁঠাল মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের একটি ফল। অর্থাৎ দেশি ফল।ম বাংলাদেশে কাঁঠালের প্রধান চারটি জাত হচ্ছে- বারি কাঁঠাল, খাজা, আদরাসা ও গালা। কৃষি তথ্য সার্ভিস জানিয়েছে সাধারণত জ্যৈষ্ঠ থেকে আষাঢ় মাসে কাঁঠাল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।
 
কলা: বারোমাসি ফল কলার উৎপত্তি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশ, আসাম ও ইন্দো চীনে হয়েছে। বাংলাদেশের উষ্ণ জলবায়ু সম্পন্ন পরিবেশ কলা জন্মানোর জন্য সবচেয়ে উপযোগী।

কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৪০-৫০টি জাতের কলার চাষ হয়। এগুলোর মধ্যে অমৃত-সাগর, সবরি, কবরি, চাঁপা, সিঙ্গাপুরি বা কাবুলি, মেহেরসাগর, এঁটে বা বীচিকলা, কাঁচকলা বা আনাজি কলা, জয়েন্ট গভর্নর এসব উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের নরসিংদী, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, বগুড়া, যশোর, ঝিনাইদহ, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় এসব কলা উৎপন্ন হয়।

এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, জেলায় বনকলা, বাংলা কলা, মামা কলাসহ বিভিন্ন ধরনের বুনো জাতের কলা চাষ হয়ে থাকে। জাম: জামের উদ্ভব হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে। পরে এটি সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। বাংলাদেশে প্রধানত দুই জাতের জাম পাওয়া জায়। একটি হল ছোট জাতের ক্ষুদি এবং আরেকটি বড় আকারের রসালো ও মিষ্টি মহিষে জাত। কৃষি তথ্য সার্ভিস জানিয়েছে, এটি মূলত গ্রীষ্মের শেষ ও বর্ষাকালের শুরুর সময়ের ফল। অন্য সব মৌসুমি ফলের তুলনায় জামের স্থায়ীকাল বেশ কম। সাধারণত জুন জুলাই মাসে এর ফল পাকে।

গাছটির প্রথমে দেখা গিয়েছে দক্ষিণ এশিয়া, সিলন, আন্দামান ও ফিলিপিন্স দ্বীপপুঞ্জে। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়ায় এ ফল ব্যাপকভাবে চাষ হয়। আমাদের দেশে কুমিল্লা, নোয়াখালী, গাজীপুর, সিলেট, ঢাকা, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় জাম বেশি উৎপন্ন হয়। টক মিষ্টি সুস্বাদু এই ফল ও বীজ বাংলাদেশ, ভারতবর্ষ, ইন্দোনেশিয়া এবং চীনে বিভিন্ন কবিরাজি বা হেকিমী চিকিৎসায়, আয়ুর্বেদী চিকিৎসা সেইসাথে ইউনানি এবং চৈনিক চিকিৎসাতে ব্যবহার হয়ে থাকে।
 
বরই/ কুল: অম্লমধুর স্বাদের ফল বরই বা কুল হল দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ফল বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী। বাংলাপিডিয়া অনুযায়ী, ভারতের উত্তরাঞ্চল, চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও মালয়েশিয়ার মধ্যবর্তী এলাকা কুলের আদি জন্মস্থান। আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার শুষ্ক এলাকায় কুলের চাষ হয়। বরইয়ের প্রায় ৪০টি প্রজাতি রয়েছে, তবে ভারতীয় কুল ও চীনা কুল সবচেয়ে বেশি চাষ হয়। বাংলাদেশে বরই এর উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে বারি কুল ১, ২ ,৩, বাউ কুল ১, ২, বিইউ কুল-১, আপেল কুল, নারিকেলি কুল ইত্যাদি বেশ নামকরা বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে জানা গিয়েছে। নারিকেলি কুল ফল লম্বাটে ও মাকু আকৃতির, অগ্রভাগ সুচালো, বীজ লম্বাটে ও ছোট, শাঁসের পরিমাণ বেশি। সাতক্ষীরা, রাজশাহী ও তার আশেপাশের এলাকায় এ কুল বেশি জন্মাতে দেখা যায়।

কুমিল্লা জেলার কচুয়া, বরুড়া ও চান্দিনা উপজেলা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় নারিকেলি কুল বা ডাব কুল বেশি জন্মে। মংলা, শরণখোলা, মোড়লগঞ্জ সহ দক্ষিণাঞ্চল; বালু জায়গা যেমন- সেন্টমার্টিন ও সোনাদিয়া দ্বীপ, টেকনাফ, কক্সবাজার, মংলা, আবার পাহাড়ি এলাকা যেমন- রাঙ্গামাটিতে চাষ হয় বাউকুল-১ ।

জাত অনুসারে মধ্য পৌষ থেকে মধ্য চৈত্র (জানুয়ারি থেকে মার্চ) মাসের মধ্যে ফল পাওয়া যায়। আখ/গেন্ডারি: ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ বা ফল আখ প্রাচীন নিবাস এশিয়ার সেইসব দেশে যেখানকার আবহাওয়া গ্রীষ্মপ্রধান, রৌদ্রোজ্জ্বল, উষ্ণ এবং মাটি আর্দ্র। বাংলাপিডিয়া বলছে আখের সরু আকৃতির জাত ভারত উপমহাদেশ, মালয়, ফিলিপাইন এবং পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ এলাকায় ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। আঠারো শতকের শুরু থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং আমেরিকায় এটি চাষাবাদ শুরু হয়। নিউগিনিতেও প্রচুর আখ জন্মায়।

বাংলাদেশের সর্বত্র কমবেশি আখ জন্মালেও চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, ঢাকা, ফরিদপুর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, যশোর, কুষ্টিয়া, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা এবং রাজশাহী আখ চাষের প্রধান এলাকা। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশে আখের চাষ হয়। তবে প্রধান আখ উৎপন্নকারী দেশগুলি হচ্ছে ভারত, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, বার্বাডোজ, চীন, কিউবা, মেক্সিকো, মিশর, জ্যামাইকা, পেরু, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই, ফ্লোরিডা এবং লুইজিয়ানা। বর্ষজীবী ফসল হওয়ার কারণে প্রায় সারা বছরই মাঠে আখ থাকে। তথ্যসূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

দৈনিক সরোবর/এএস