ঢাকা, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১

অনলাইনে বেড়েছে প্রতারণা 

লোভের ফাঁদে নিঃশেষ হচ্ছেন ভোক্তারা 

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: মে ১৮, ২০২৪, ০৮:০৮ রাত  

হঠাৎ করেই দেশে বেড়েছে প্রতারণা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) জরিপে দেখে গেছে, চলতি বছরের শুধু জানুয়ারি মাসে ঢাকা মহানগরীতে ৭৮টি প্রতারণার মামলা হয়েছে। বেশিরভাগ ঘটনায় দেখা গেছে প্রতারক চক্রগুলো টার্গেট করছে স্বল্পশিক্ষিত, চাকরি প্রত্যাশী ও বেকার মানুষ। তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব চক্রের সদস্যরা। 

অনলাইনে অত্যন্ত কম মূল্যে পণ্য ক্রয়ের প্রলোভন। কখনো শুধু ভেলিভারি চার্জ অগ্রিম পাঠানোর শর্তের সঙ্গে রিভিউ ও কমেন্ট বক্সে প্রশংসনীয় সব মন্তব্য। তা স্রেফ ভাড়াটে। লোভনীয় ও চটকদার এমন ফাঁদে পা দিলেই সর্বনাশ! একবার কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর ফেসবুক পেজটি ডিলেট করে নতুন নামে ফের খোলা হচ্ছে পেজ ও ওয়েবসাইট। এভাবেই চলছে প্রতারণা। পেজ ও ওয়েবসাইটের ভোল পাল্টালেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মার্চেন্ট নম্বরটি থাকছে একই। পুলিশে অভিযোগ দিয়েও কোনো সুরাহা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। এতে বন্ধ হচ্ছে না প্রতারণার নতুন ফাঁদ।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব আছে। লোভের ফাঁদে পড়েই অধিকাংশ মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন।

জানা গেছে, দেশে ফেসবুকভিত্তিক ই-কমার্স পেজ খুলে নামমাত্র মূল্যে গ্রাহকদের বিভিন্ন পণ্যের অফার করা হচ্ছে। অগ্রিম হিসেবে প্রাপ্ত টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর গায়েব করে হয়ে যাচ্ছে ওই ফেসবুক পেজ বা ওয়েবসাইট। এরপর পেজ ও ওয়েবসাইটের নাম পরিবর্তন করে একই কায়দায় চক্রটি গ্রাহকদের থেকে ফের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, এমনকি এ বিষয়ে সাইবার পুলিশ সেন্টারে অভিযোগ জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি ভুক্তভোগীরা। আমারকার্ট ডটকম নামে একটি ই-কমার্স ফেসবুক পেজ থেকে গত ৩০ এপ্রিল একটি টেবিল ফ্যান অর্ডার করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির উদ্বোধন উপলক্ষে মাত্র ৮৯ টাকায় ফ্যান অফার করে প্রতিষ্ঠানটি। বলা হয়, একদিনের মধ্যেই পণ্যের হোম ডেলিভারি দেয়া হবে। তাদের দেয়া বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠানো হয়। পেমেন্ট করার তিন দিনের মাথায় মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। পেজটির সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। ফোন নম্বরগুলোও বন্ধ এবং অফিসের কোনো সন্ধ্যান মিলছে না।

এ বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, অনলাইন প্রতারণার বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত সাইবার প্যাট্রোলিং চালু আছে। প্রতারণাকারী এ ধরনের ফেসবুক পেজ বন্ধ করতে আমরা বিটিআরসির কাছে পাঠাই। অনেক পেজই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভুক্তভোগীরা সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারে অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে অনলাইনে দেখে-শুনে কেনা এবং পণ্য হাতে পেয়ে টাকা পরিশোধের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, বর্তমানে অপরাধের আরেকটি বড় প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে সাইবার অপরাধ। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে খুব একটা জানাশোনা নেই। ফলে না বুঝেই ইন্টারনেটে অনেক কাজ করে পরে বিপদে পড়ছে এবং প্রতারকদের খপ্পরে।

একই মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অঙ্কের টাকা; ধোঁকা দিতে কমেন্ট বক্সে ভাড়াটে মন্তব্য

আমারকার্ট অনলাইন শপিং নামের ওই পেজের প্রতারণার শিকার হয়েছেন এমন অন্তত আটজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রায় ২৭ হাজার ফলোয়ারের একটি ই-কমার্স পেজ। তারা বিশ্বাস করেই টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন। কিন্তু পণ্য পাননি। একাধিকবার চেষ্টা করেও ওই পেজে দেয়া কোনো মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেননি ভুক্তভোগীরা। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ফেবলি অনলাইন শপিং এ বছর আমারকার্ট অনলাইন শপিং নামে ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইট চালু করে। এরপর নামমাত্র মূল্যে মোবাইল ফোন, রিচার্জেবল ফ্যান ও ইয়ারবাডসের অফার করে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করছে দুটি মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর। ওই একই নম্বর ব্যবহার করে গত বছর ফেবলি অনলাইন শপিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করেছিল চক্রটি। চক্রটি মার্চেন্ট নম্বর একই রেখে কয়েক দিন পরপর ই-কমার্স পেজের নাম পাল্টে ফেলে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি বিক্রেতা দামি কোনো পণ্য কম দামে বিক্রির কথা বলেন; বুঝবেন প্রতারিত হতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে আপনাকে হয়তো সেই প্রতিষ্ঠান নকল পণ্য দেবে; নতুবা কোনো পণ্যই দেবে না। প্রলোভনে না পড়ে প্রতিষ্ঠানটির যথার্থতা যাচাই-বাছাই করুন। পণ্য হাতে পাওয়ার পর মূল্য পরিশোধ করুন। নতুন পেজ কমেন্ট বক্স বা রিভিউ পদ্ধতি না থাকলে পণ্য কেনা যাবে না।

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার রতন বিশ্বাস নামে এক ক্রেতা জানান, ফেবলি অনলাইন শপিংয়ে ইয়ারবাডস কিনতে তিনি অগ্রিম টাকা দেন। বছর পেরিয়ে গেলেও পণ্যটি তার হাতে পৌঁছেনি। এক সময় ফেসবুকের পেজটি গায়েব হয়ে যায়। তিনি অভিযোগ করেন, পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েও কোনো সুরাহা পাননি। 

আরেক ভুক্তভোগী কামরুল ইসলাম বলেন, অর্ডার করার পর সাত দিন অপেক্ষা করলাম। এরপর তাদের ফেসবুক পেজে মেসেজ দিলে আমাকে ব্লক করে দেয়। তিনি বলেন, গ্রাহক ঠকাতে অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছে প্রতারক চক্রটি। ফেসবুক পেজে দেয়া এসব লোভনীয় অফারকে বিশ্বাসযোগ্য করাতে নিজেদের লোক দিয়ে প্রোডাক্ট প্রাপ্তির কমেন্ট করায়।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, ফেসবুক পেজে কথার প্রলোভনে পড়ে সরল বিশ্বাসে অগ্রিম টাকা দিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতারিত হতে হয়। প্রতারকচক্র অগ্রিম টাকা নিতে না পারলে পণ্যের ডেলিভারি চার্জের নামে ১০০ থেকে ২০০ টাকা নেয়ার পর নম্বর ও ফেসবুক আইডি ব্লক করে দেয়। এসব চক্র কদিন পরপরই আগের আইডি ডিলেট করে নতুন নতুন আইডি খোলে। এসব ক্ষেত্রে থানায় অভিযোগ করলেও আত্মসাৎকৃত অর্থ ফিরে পাওয়ার নজির কম। এসব কারণে অধিকাংশ ভুক্তভোগীই পুলিশের কাছে অভিযোগ করার আগ্রহ পর্যন্ত হারাচ্ছেন।

ফেসবুক পেজের মাধ্যমে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া একাধিক ব্যবসায়ী জানান, ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। নারীরাও বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। কিন্তু ফেসবুকে কেনাকাটার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির মানুষ প্রতারণা করছে। তাদের কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের সুনামও নষ্ট হচ্ছে। একজন ক্রেতা একবার প্রতারিত হলে ফেসবুক পেজ থেকে আর কখনো পণ্য কিনতে চাইবে নাÑ এটিই স্বাভাবিক। ফলে বড় একটি মার্কেটপ্লেস নষ্ট হচ্ছে।

বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, ই-কমার্স মনিটরিংয়ের জন্য পৃথক সেল গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার ক্রাইম ইউনিটগুলোরও স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজ করা উচিত। এর পাশাপাশি সচেতন হতে হবে গ্রাহকদেরও।

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ