ঢাকা, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১

ভোগান্তি আর পকেট খালি

প্যাকেজের ফাঁদে মোবাইল ফোন গ্রাহকরা 

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৪, ০৮:৪৫ রাত  

মোবাইল টেলিফোন ও ইন্টারনেট সেবায় গ্রাহকদের ভোগান্তি কমছে না; বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। অপারেটরদের নানা অফারের ফাঁদে ফেলে প্রত্যেক গ্রাহকের কাছ থেকে ৫-১০ টাকা করে কেটে নিচ্ছে। দেশে প্রায় ১০ কোটি ইন্টারনেট গ্রাহকদের কাছে থেকে প্রতি বছর মোবাইল কোম্পানিগুলো লুটে নিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।

ইন্টারনেট এক গোলকধাঁধা। এর চক্করে পড়লে আর রক্ষা নেই; শুধু টাকাই যায়। ইচ্ছামতো কোম্পানিগুলো প্যাকেজ তৈরি করছে আর সেটি গ্রাহকদের কাছে পাঠাচ্ছে; নেই কোনো নিয়ম বা আইনের বালাই। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিনের পর দিন এভাবেই চলছে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো। হাজার রকমের প্যাকেজের নামে জোচ্চুরি করে গ্রাহকের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে টাকা। এত অফারের প্যাকেজগুলো দেয়া হচ্ছে শুধু মানুষকে বোকা বানাতে।

জানা গেছে, গত দুই বছরে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে গ্রাহকরা প্রায় ৪২ হাজার অভিযোগ জমা দিয়েছেন টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে। এর মধ্যে ২৫ হাজার ৯৫টিই ভয়েস কল ও মোবাইল ইন্টারনেট সেবা নিয়ে। অসহনীয় মাত্রায় কল কেটে যাওয়া (ড্রপ), ইন্টারনেটে ধীরগতি, বিভিন্ন প্যাকেজের ফাঁদ, গ্রাহকের অজান্তে ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস চালু করে টাকা কেটে নেওয়া - এ রকম অভিযোগই বেশি। শুধু বিটিআরসিতে জমা পড়া অভিযোগ নয়, গ্রাহকদের সঙ্গে আলাপ করে একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, মোবাইল ফোনে কথা বলে শান্তি নেই, বারবার কেটে যায়। ইন্টারনেটও সাশ্রয়ী নয়; ব্যবহারে নানা কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেয়। তবু বাধ্য হয়ে ব্যবহার করতে হচ্ছে।

গ্রাহকদের অভিযোগ, মোবাইল অপারেটরদের ফেসবুক, ইউটিউব ব্যবহারের জন্য সুনির্দিষ্ট ডেটা প্যাকেজ নিতে গিয়ে তারা প্রতারিত হচ্ছেন। কম টাকায় বেশি ডেটার অপারেটরের লোভনীয় অফারের মেসেজ দেখে অনেকেই প্যাকেজ কিনে দেখছেন, সুনির্দিষ্ট একটি অ্যাপ ছাড়া আর কিছুতেই এ প্যাকেজের ডেটা ব্যবহার করা যায় না। বাংলাদেশি মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্যও অনেক বেশি। প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে মূল্য অনেক বেশি। ভারতে মোবাইল অপারটেররা প্যাকেজে গ্রাহকদের যে সুবিধা দেয়, বাংলাদেশি অপারেটররা তা দেয় না।
বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়াই বিভিন্ন প্যাকেজ ও অফার দিচ্ছে মোবাইল অপারেটররা। দিনের কোন অংশে কত পয়সা মিনিট বা সেকেন্ড আবার কোন নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা রিচার্জ করলে ‘এত মিনিটি ও এত এসএমএস ফ্রি’। এসব অফার পাঠিয়ে গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে। গ্রাহকরা এসব অফার গ্রহণ করে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। একইভাবে ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও অফার দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। মোবাইল গ্রাহকরা এসব এসএমএসের কারণে এখন অতিষ্ঠ। এরপরও অপারেটররা কাজটি করেই যাচ্ছে।

মোবাইল অপারেটররা গ্রাহক ঠকিয়ে লুটছে হাজার হাজার কোটি টাকা

বাংলাদেশে অপারেটররা গ্রাহকদের লোভনীয় কিছু বিশেষ অফার দেয়; যেখানে ভয়েজ কল-ইন্টারনেটের মূল্য কম পড়ে। কিন্তু এগুলোয় অব্যবহৃত ডেটা গ্রাহককে ফেরত দেয়া হয় না। আবার বাংলাদেশে ইউটিউব, ইমো, ফেসবুক প্রভৃতি অ্যাপের জন্য সুনির্দিষ্ট ডেটা প্যাকেজ দেয়া হয়। যেখানে কম টাকায় বেশি ডেটা থাকলেও তা দিয়ে সাধারণ ব্রাউজিংয়ের সুযোগ থাকে না। ভারতের প্রায় সব ইন্টারনেট প্যাকেজে আনলিমিটেড ভয়েস কল সুবিধা থাকলেও বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো সুবিধা দেয়া হয় না। 

অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় ইন্টারনেট প্যাকেজের ফাঁদে ফেলে দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটররা সাধারণ গ্রাহকদের পকেট কাটছে বলে অভিযোগ করেছে টেলি কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিক্যাব)। 

বান্ডেল অফারেও গ্রাহক ঠকছেন বলে অভিযোগ করেন টিক্যাবের আহ্বায়ক মুর্শিদুল হক বলেন, অপারেটরগুলো বান্ডেল অফার নামে ইন্টারনেট, টকটাইম ও এসএমএস-এর সমন্বয়ে বিভিন্ন প্যাকেজ গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে অনেক বেশি ডেটা, মিনিট ও এসএমএস দেয়া হলেও মেয়াদ দেয়া হচ্ছে কম। তিনি বলেন, অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে প্যাকেজের বড় একটি অংশ। কিন্তু অপারেটরগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ সেই ডেটা চক্রাকারে পুনরায় গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। 

অবিলম্বে গ্রাহকদের লোভনীয় প্যাকেজের ফাঁদে ফেলে পকেট কাটা বন্ধ করার দাবি জানিয়ে মুর্শিদুল হক বলেন, নির্দিষ্ট অ্যাপ ব্যবহার ও প্যাকেজের মেয়াদ বেঁধে দিয়ে গ্রাহকদের টাকা কেটে নেয়ার এ ফরমুলা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অনৈতিক। বেশি দামের বিষয়ে জানতে চাইলে মোবাইল ফোন অপারেটর রবির চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মো. শাহেদুল আলম একটু ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে ইন্টারনেটের দাম এক অর্থে কম। কারণ ওখানে একজন গ্রাহককে মাসে কমপক্ষে ১৩৫ টাকা ব্যবহার করতে হয়। এটা সর্বনিম্ন খরচ। না হলে তারা সিম বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটরদের গ্রাহকপ্রতি মাসিক আয় ১২০ টাকা। তাদের চেয়ে ১৫ টাকা কম।

বিটিআরসির এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিদিন একজন গ্রাহকের কাছ থেকে কম করে হলে ৫ থেকে ৬ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন অফার ও প্যাকেজের নামে। তাহলে কয় হাজার কোটি টাকা মোবাইল অপারেটরা বিনা সেবায় নিয়ে যাচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে বিটিআরসি যতবার উদ্যোগ নিয়েছে ততবারই কোনো না কোনোভাবে এ উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। অপারেটরদের শক্তি কোথায়, তা নির্ণয় করা কঠিন। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধ উপায়ে তারা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। মোবাইল অপারেটরদের বিভিন্ন প্যাকেজ ও অফার নিয়ে এবারের বোর্ড সভায় যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হবে কিনা; এটি নিয়েও তিনি সংশয় প্রকাশ করেন। 

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, এটি এক ধরনের অরাজকতা। গ্রাহকদের স্বার্থ বিবেচনা করে মনিটরিং সেল স্থাপন করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কোনো অপারেটরকে ছাড় দেয়া হবে না। গ্রাহক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে বিটিআরসি বোর্ড সভায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

বিটিআরসি সিদ্ধান্তগুলো হলো, সাধারণ গ্রাহক কোন না কোনভাবে প্রতারিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে (ন্যূনতম সম্ভাবনা) বা আশঙ্কা রয়েছে এমন কোন প্যাকেজ বা অফার অনুমোদন দেয়া হবে না। গ্রাহকদের ফিটব্যাক ব্যবস্থা রাখতে হবে। কোন প্যাকেজ বা অফারের মেয়াদ সর্বনিম্ন ৭ দিন হতে হবে। তবে ঈদ, পূজা, বড়দিন ও নববর্ষ এসব ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা আলাদাভাবে স্বল্প সময়ের জন্য অনুমোদন দেয়া হবে। যদি কোনো অপারেটর বিশেষ দিনগুলোয় নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে কম অফার দেয়; তাহলে ওই অপারেটরের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো অফার বা প্যাকেজ গ্রাহকের অনুমোদন ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হবে না। কোনো অফার শেষ হওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মাসিক অফার হতে হবে ন্যূনতম ৩০ দিন। মাসিক অফার ৩০ দিনের এক ঘণ্টা কম হলেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

যেসব গ্রাহক বিটিআরসিতে অভিযোগ দিয়েছেন, তারা সমাজের সচেতন ও শিক্ষিত মানুষ। তাদের বিটিআরসি পর্যন্ত আসার মতো সুযোগ রয়েছে। যারা খুব সাধারণ গ্রাহক, তারা নানাভাবে প্রতারণার শিকার হলেও বিটিআরসি পর্যন্ত আসতে পারছেন না। দেশে বর্তমানে ১২ কোটির উপরে মোবাইল গ্রাহক আছেন। প্রতিদিন যদি মোবাইল অপারেটররা এক টাকা করেও হাতিয়ে নেয়, তাহলে প্রতিদিন ১২ কোটি টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে চলে যাচ্ছে। মাসে ৩৬ কোটি টাকা। আর বছরে ৪৩২ কোটি টাকা গ্রাহকদের পকেট থেকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এ হিসাব আরও অনেক বড়। 

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ