বিদেশমুখী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে
তরুণ শিক্ষিতরা উচ্চশিক্ষায় দেশ ছাড়ছেন
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৩, ০৮:৫৮ রাত

দেশ ত্যাগ করার নীরব বিপ্লব শুরু হয়েছে। শিক্ষিত ও মেধাবী অনেকের কাছে বিদেশে যাওয়া-ই একমাত্র সমাধান। বেশির ভাগ তরুণদের স্বপ্ন এখন দেশ ত্যাগ করা- যেন দেশ ত্যাগ করতে পারলেই বাঁচে। তাই দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া শিক্ষিত তরুণের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাদের আড্ডায় এখন সব বিষয় ছাপিয়ে উঠে আসছে বিদেশ যাওয়ার বিষয়। দেশে ভালো বেতনের চাকরি ছেড়েও বিদেশমুখী হচ্ছেন অনেকে। ইংরেজি ভাষা শিখে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে চলে যাচ্ছেন ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশে। সেখানে গিয়ে আবারও উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হচ্ছেন। শিক্ষাজীবন শেষে থেকে যাচ্ছেন ওই দেশেই। নিয়ে যাচ্ছেন পরিবার। আবার দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়ে সেখানে স্থায়ী হয়ে যাচ্ছেন। প্রতি বছরই এমন বিদেশমুখী তরুণের সংখ্যা বাড়ছে।
স্টুডেন্ট ভিসায় বিদেশ গিয়েছেন বা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন অনেকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, উচ্চশিক্ষা শেষ করেও চাকরি না পাওয়া; যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের অভাব, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা, সুচিকিৎসা নিয়ে অনিশ্চয়তা, দুর্নীতি ছাড়া সেবা না পাওয়া, ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা, দূষিত পরিবেশ, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের মতো বিষয়গুলো তাদের দেশ ছাড়তে উৎসাহিত করছে।
সাইদুর রহমান সম্রাট ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করেছেন। এ পর্যন্ত তিনবার বিসিএস পরীক্ষা দিলেও এখনো সফল হতে পারেননি। তবে হাল ছাড়ছেন না। সরকারি চাকরি পাবার বয়স-সীমা অতিক্রম না করা পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। কিন্তু এতকিছুর মাঝে বিদেশে পাড়ি জমানোর আগ্রহই যেন বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা অরেক ছাত্র আদিল বলছিলেন- যখন পড়াশোনা করেছি, তখন আমার এবং আমার পরিবারের একটা আশা ছিল যে ভালো একটা চাকরি করবো। যতদিন চাকরি না পাই ততদিন ট্রাই করে যাব। সর্বশেষ না পেলে বিদেশে পাড়ি জমাবো।
শুধু শিক্ষার্থী নন, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর নার্স, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও দেশ ছাড়ছেন। অনেক শিক্ষক বিদেশে এমএস ও পিএইচডি করতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে যান। বিদেশে থাকাকালীন তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত বেতন নেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাঁচ বছরের বেশি সময় তাদের বেতন দিয়ে যায়। কিন্তু ডিগ্রি শেষে দেশে ফিরতে তারাও অনিচ্ছুক। মূলত শিক্ষা বা ডিগ্রিকে বিদেশে ঠাঁই নেয়ার একটা উপায় হিসেবে ব্যবহার করেন তারা।
প্রতিবছর ৪০ হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে যান এবং শিক্ষাজীবন শেষে সেখানেই থেকে যান
দেশে পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধার অভাব, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা, চিকিৎসা ও ন্যায়বিচারে অনিশ্চয়তা, দূষিত পরিবেশ এবং সন্তানের ভবিষৎ নিয়ে উৎকণ্ঠায় অভিভাবরা
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, বেকারত্বের কারণে অনেকে বিদেশ যাচ্ছেন। তবে বিদেশ গিয়ে যদি কেউ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে সেটা খারাপ নয়। এটা তার জন্যও ভালো, দেশের জন্যও ভালো। সে রেমিট্যান্স পাঠাবে। তিনি বলেন, দেশের সব মেধাবীরাই যদি বিদেশে পাড়ি দেয়; তাহলে দেশের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। দেশকে এগিয়ে নিতে উদ্ভাবন দরকার। মেধাবীদের ফিরতে হবে। এ জন্য যারা বিদেশে যাচ্ছে তারা ফিরলে যেন যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত কাজ ও সম্মান পায় সেই ব্যবস্থা সরকারি ও বেসরকারিভাবে করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ জন্য এখানকার ডিগ্রি নিয়ে অনেক দেশে গিয়ে ভালো চাকরি মেলে না। শিক্ষার মান বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে আনতে হবে।
বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশন এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শিক্ষিত তরুণদের মাঝে বেকারত্ব বেশি। যাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই তারা কোনো না কোনো কর্মসংস্থানে নিজেদের জড়িত রেখেছেন। সেটি নিম্ন মজুরীতে হলেও। কিন্তু শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সার্বিকভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও শিক্ষিতদের মাঝে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়াটা অর্থনীতি এবং সমাজের জন্য একটি অশনিসংকেত। আসছে দিনগুলোতে বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার প্রায় চার ভাগের একভাগের নিয়মিত কোন কর্মসংস্থান নেই। উচ্চ-স্তরের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার সুযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী দেশগুলির প্রলোভন মানুষকে বিদেশে পাড়ি দিতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। কারণ পেশাদাররা নিজেদের এবং তাদের পরিবারের জন্য উন্নতমানের জীবন কামনা করে। পরিবারের উন্নত মানের জীবনযাত্রার পাশাপাশি বাইরের দেশগুলো প্রায়ই মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দেয়। তাই অভিভাবকরা সন্তানদের সর্বোচ্চ মানের শিক্ষা দিতে সেদিকে আকৃষ্ট হন। এই আকাক্সক্ষার জন্য প্রায়ই বাবা-মায়েরা সন্তানদের নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেন। এমনকি বিদেশে তাদের ক্যারিয়ার অসুবিধার সম্মুখীন হলেও তারা পরোয়া করেন না।
ইউনেস্কোর ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিসটিক্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি বছরই ৪০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। করোনার দুই বছর বাদে ২০১৯ সাল থেকে এই সংখ্যা বাড়ছে। গত দুই বছরে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৭ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমিয়েছেন। এছাড়া মালয়েশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রচুর শিক্ষার্থী যাচ্ছেন উচ্চশিক্ষা অর্জনে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসম জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালে প্রতি হাজারে তিনজন দেশ ছেড়ে বিদেশে অভিবাসী হয়েছেন। গত বছর এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে হাজারে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ।
ইউনেস্কোর তথ্যানুযায়ী ২০১৮ সালে দেশের বাইরে পড়তে গিয়েছিলেন ২৪ হাজার ১১২ শিক্ষার্থী। ২০২০ সালে সে সংখ্যা চারগুণ বেড়েছিল। ইউনেস্কোর তথ্য বলছে, উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতি বছর গড়ে ৭০-৮০ হাজার বাংলাদেশী শিক্ষার্থী বিদেশে ভ্রমণ করছেন। তবে প্রতি বছর বাংলাদেশে যত শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দাঁড়ায়। সে তুলনায় এ সংখ্যা খুব কম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিদেশে যারা যাচ্ছেন, মেধা ও দক্ষতার জোরেই যাচ্ছেন। দুঃখজনক হলো, দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট থেকে প্রতি বছর বড় একটি সংখ্যা বিদেশ চলে যান। সেখান থেকে খুব কমই দেশে ফিরে আসতে চান।
ইউএনএফপির তথ্যানুযায়ী ২০২২ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বয়স ১৫-৩৫ বছর। এ বয়সে মানুষ দ্রুত শিখতে পারে ও নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব তাদের নিম্নমুখী জন্মহারের কারণে কর্মী চাহিদা মেটানোর জন্য শিক্ষায় বৃত্তি দিয়ে অভিবাসী নিচ্ছে। আর এ সুযোগ লুফে নিচ্ছেন বাংলাদেশি তরুণরা। পাঁচ বছর আগে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এক জরিপে দেখেছে, বাংলাদেশ থেকে ১৫-২৯ বছর বয়সী ৮২ শতাংশ মানুষ দেশ ছাড়তে আগ্রহী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে উন্নয়নে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই, সে উন্নয়নে জনগণ আস্থা রাখতে পারছে না। আর ব্রীজ-ফ্লাইওভার দৃশ্যমান উন্নয়নের চেয়ে বেশি প্রয়োজন কর্মসংস্থান এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন। বাংলাদেশ এ দুটোতে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ফলে দৃশ্যমান উন্নয়নের চেয়ে জনসম্পদ উন্নয়নের দিকে জোর দিতে হবে।