ঢাকা, শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির শঙ্কা

ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনে ধস

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: নভেম্বর ০৩, ২০২৪, ০৯:০১ রাত  

দেশে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। তিন মাস ধরে কমছে ব্যাংকের ক্রেডিট কাডের্র লেনদেন। তবে এ সময়ে বেড়েছে কার্ডের সংখ্যা। একই সময়ে ডেবিট কার্ডে লেনদেন বাড়লেও ক্রেডিট কার্ডে কেন লেনদেন কমছে, তা জানতে চলছে তথ্য বিশ্লেষণ। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুসারে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ডলার খরচ ১৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। অক্টোবরে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকরা ২ হাজার ২৩২ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন। সেপ্টেম্বরে লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৩০২ কোটি টাকা। জুলাইতে ক্রেডিট কার্ডে ২ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকার লেনদেন হয়। ডেবিট কার্ডে একক মাস অক্টোবরে লেনদেন ৩৪ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে লেনদেন হয় শুধু ৩১ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। 

ব্যাংকাররা বলছেন, আমদানি কমাতে জারি করা বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে কার্ডের ব্যবহার কমেছে। এছাড়া আর্থ সামাজিক অনেক বিষয় ভূমিকা রাখছে লেনদেন কমায়। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন এভাবে কমার মূল কারণ গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে অস্থিরতা, কিছু ব্যাংকের তারল্য সংকট ও আর্থিক খাতের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া। 

দেশভিত্তিক লেনদেনের পরিসংখ্যান বলছে, ক্রেডিট কার্ডধারীরা বিদেশে কার্ড সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন ডিপার্টমেন্ট স্টোরে। মোট লেনদেনের ২৭ শতাংশ হয়েছে এ খাতে। অন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্যাটাগরির মধ্যে রিটেইল আউটলেট সার্ভিসে ১৭ শতাংশ, ফার্মাসিউটিক্যালসে ১২ শতাংশ, পরিবহণে ১০ শতাংশ, ব্যবসায়িক সেবায় ৭ শতাংশ; পোশাকে ৭ শতাংশ ও অন্যান্য ক্যাটাগরিতে ২০ শতাংশ লেনদেন হয়েছে। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি খরচ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। মোট লেনদেনের ২০.১৭ শতাংশই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশভিত্তিক অন্যান্য লেনদেনের মধ্যে ভারতে ১৪ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৯ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৯ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৮ শতাংশ, কানাডায় ৭ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৪ শতাংশ, আরব আমিরাতে ৪ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ৩ শতাংশ, নেদারল্যান্ডসে ৩ শতাংশ ও আয়ারল্যান্ডে ৩ শতাংশ লেনদেন হয়েছে।

কার্ডের মাধ্যমে ডলার খরচ ১৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমেছে

এ প্রসঙ্গে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনের প্রধান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জুলাই ও আগস্ট মাসের প্রভাবে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার অনেক কমে গিয়েছিল। চলমান মূল্যস্ফীতির কারণে গ্রাহকরা খরচের রাশ টেনে ধরার পাশাপাশি দেশজুড়ে অস্থিরতার কারণে ব্যাংকও স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারছে না। ফলে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনে পতন হচ্ছে। একই সঙ্গে ওই দুই মাসে ব্যাংক খাতে নতুন ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করাটাও বেশ কমেছে। তবে অক্টোবর থেকে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ইসলামি ধারার অনেক ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে ঠিকমতো লেনদেন করা যায়নি। এটি সমস্যা তৈরি করেছে। তারল্য সংকটে থাকা অনেক ব্যাংক থেকে ঠিকমতো টাকা তুলতে না পারায় অনেক মার্চেন্ট পিওএস-এর মাধ্যমে পেমেন্ট নেওয়া বন্ধ রেখেছে। তিনি বলেন, এর পাশাপাশি সমস্যাগ্রস্ত অনেক ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ক্যাশ উত্তোলন বন্ধ রেখেছে। একইসঙ্গে সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে কর্মরত পার্শ্ববর্তী দেশের অনেক নাগরিক তাদের দেশে ফেরত গেছেন। এদের একটা বড় অংশ ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন করত। ফলে সবমিলিয়ে লেনদেনে একটা নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে মোটাদাগে ১১টি খাতে ক্রেডিট কার্ড বেশি ব্যবহৃত হয়। এসব খাতের মধ্যে রয়েছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, খুচরা কেনাকাটা, বিভিন্ন পরিষেবার বিল প্রদান, নগদ উত্তোলন, ওষুধ ও ফার্মেসি, পোশাক কেনাকাটা, অর্থ স্থানান্তর, পরিবহণ খাতে ব্যয়, বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও পেশাদারি সেবা এবং সরকারি সেবার বিল প্রদানে। এসব খাতের মধ্যে শুধু পোশাক-আশাক কেনায় অক্টোবর মাসে খরচ কম করেছেন ক্রেডিট কার্ডধারীরা। সেপ্টেম্বরে পোশাক-আশাক কেনায় ক্রেডিট কার্ডে খরচ করা হয় ২৫৪ কোটি টাকা। তা অক্টোবর মাসে কমে ১১২ কোটি টাকায় নেমে আসে। শুধুমাত্র এই খাতেই এক মাসে খরচ কমেছে ১৪২ কোটি টাকা বা ৫৬ শতাংশ।
গ্রাহকরা বলছেন, ব্যাংকে গেলে প্রয়োজনীয় টাকা ওঠানো যাচ্ছে না। এতে প্রয়োজনের সময় পড়তে হচ্ছে বিপাকে। 

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল মান্নান বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকখাতে লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে; দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। সারা বিশ্বে এটি নজিরবিহীন। গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে দ্রুত ব্যাকগুলোতে তারল্য বাড়াতে হবে। তবে এতসব শঙ্কার মধ্যেও রয়েছে সম্ভাবনার হাতছানি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাঠামোগত সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ব্যাংক খাতে দৃশ্যমান সুফল আসবে নিশ্চয়। 

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট কাজী আনোয়ারুল আজম বলেন, ক্রেডিট কার্ডে গ্রাহকদের অর্থ দিতে কষ্ট হচ্ছে। তারপরও যতটুকু অর্থ দেয়া যায়; তা দেয়া হচ্ছে। ব্যাংক খাতে লেনদেন স্বাভাবিক করতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেয়ার ব্যবস্থা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দ্রুত তারল্য সহায়তা দেয়া না হলে ব্যাংক খাতে লেনদেনে গ্রাহকদের আস্থা আরও কমবে বলে শঙ্কা ব্যাংকারদের।