ঢাকা, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১

বৈষম্য রেকর্ড ছাড়িয়েছে ভারতে

সরোবর ডেস্ক 

 প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২৪, ০৬:০৭ বিকাল  

ভারতে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। দেশের জাতীয় সম্পদের ৪০ শতাংশই রয়েছে দেশের ১% ধনকুবেরের হাতে। এমনটাই দাবি করেছে ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের সাম্প্রতিকতম তথ্য। ভারতের ‘আধুনিক বুর্জোয়াদের নেতৃত্বাধীন কোটিপতি রাজ ঔপনিবেশিক শক্তির নেতৃত্বে ব্রিটিশ রাজের চাইতেও বেশি অসম’-এমন কথাও বলা হয়েছে ‘ইনকাম অ্যান্ড ওয়েলথ ইনিকুয়ালিটি ইন ইন্ডিয়া, ১৯২২-২০২৩- দ্য রাইজ অফ দ্য বিলিওনিয়ার রাজ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে। আরো বলা হয়েছে ২০১৪-১৫ এবং ২০২২-২৩ সালে এই বৈষম্য রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসেন। ২০২২-২৩ সালে ভারতের ধনীতম ১ শতাংশের উপার্জন ও সম্পদ সর্বোচ্চ হয়েছে। ওই ১ শতাংশের হাতে কুক্ষিগত হয়েছে দেশের মোট উপার্জনের ২২.৬ শতাংশ এবং মোট সম্পদের ৪০.১ শতাংশ। ওই ধনকুবেরদের উপার্জন এবং সম্পদ বিশ্বের মধ্যেও অন্যতম সেরা। ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, এমন কী আমেরিকার মতো দেশগুলির থেকেও এগিয়ে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশী ধনীদের তালিকায় থাকা ১ শতাংশের হাতে রয়েছে দেশের মোট উপার্জনের ২০.৯ শতাংশ, ব্রিটেনের ক্ষেত্রে তা ১০.২ শতাংশ।

সাম্প্রতিক প্রকাশিত এই প্রতিবেদনকে ঘিরে আপাতত আলোচনা তুঙ্গে। এ বিষয়ে নিজ্ঞাসা করা হলে অর্থনীতিবিদ ড. রাজীব কুমার বলেন, এই তথ্য সঠিক কি না সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় কারণ যে পদ্ধতিতে এই সমীক্ষা করা হয়েছে এবং কী ব্যাখা করা হয়েছে, আমি তা খতিয়ে দেখিনি। তবে এই সমীক্ষায় একটি বিশাল সময় সীমার কথা তুলে ধরা হয়েছে।

নীতি আয়োগের সাবেক সহ সভাপতি ছিলেন ড. রাজীব কুমার। অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি বিগত কয়েক দশকে মধ্যবিত্তদের বিরাট অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। সে দিক থেকে বৈষম্য কমার কথা। দারিদ্র সীমার নিচে থাকা আমরা যদি দেখি তাহলে বহু মানুষ সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এবং সেটা কিন্তু ৯০-এর দশক থেকেই হয়েছে এবং সব সরকারই এ বিষয়টিতে নজর দিয়েছে।

অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ ড সুনেত্রা ঘটক বলেন, এর আগেও আয় এবং সম্পদের বৈষম্য নিয়ে করা একাধিক গবেষণায় এ কথা বলা হয়েছে। এই বৈষম্য কিন্তু দেশের সার্বিক উন্নতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে যদি না এখনই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। দীর্ঘমেয়াদী ক্ষেত্রে দেশের জিডিপি গ্রোথএর ফলে কমবে। ভারতে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা বেসরকারি সংস্থা অক্সফ্যামও এর আগে বলেছিল।

পরিসংখ্যান প্রকাশিত হওয়ার পর বিরোধীরা সরব হয়েছেন। কংগ্রেসের জয়রাম রমেশ বিজেপি সরকারকে কটাক্ষ করেছেন। তার দাবি, প্রধানমন্ত্রীর শাসনকালে ২০১৪ থেকে এ পর্যন্ত এই বৈষম্য আরো বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। তিনি বলেছেন, মোদ্দা কথা হল এটা নরেন্দ্র মোদীর বিলিওনিয়ার রাজ যেখানে প্রধানমন্ত্রী তার পার্টির প্রচার ফান্ডের কথা ভেবে বন্ধুদের সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন। এবং এটা ব্রিটিশ রাজের থেকেও বেশি বৈষম্যমূলক।

অন্যদিকে, বিজেপির দাবি সরকার আমজনতার পক্ষে। ধনী এবং দরিদ্রদের অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে বিজেপির জমানায়, একথা ঠিক নয় বলে তারা বলছেন।

প্রথমত সরকার কিন্তু সাধারণ মানুষের সার্বিক উন্নতির দিকে বরাবরই খেয়াল রেখেছে। এবং এটা প্রমাণিত যে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের উন্নতি হয়েছে। অর্থনীতির নিরিখেও দেশ এগিয়ে’-বলেছেন বিজেপির মুখপাত্র শায়না এনসি। সমীক্ষায় যা বলা হয়েছে: গত ১০০ বছরের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ‘ইনকাম অ্যান্ড ওয়েলথ ইনইক্যুয়ালিটি ইন ইন্ডিয়া, ১৯২২-২০২৩: দ্য রাইজ অব দ্য বিলিয়নেয়ার রাজ। ১৯২২ সাল থেকে ভারতে উপার্জন ও সম্পদের এক শতাব্দীর খতিয়ান তুলে ধরেছেন টমাস পিকেটি, লুকাস চ্যান্সেল, অনমোল সোমাঞ্চিএবং নীতিন কুমার ভারতীর মতো অর্থনীতিবিদ এবং গবেষকরা। সেখানে বলা হয়েছে ১৪০ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার এই দেশে আয় এবং মোট সম্পদের নিরিখে ধনী এবং দরিদ্রদের মধ্যে বৈষম্য আকাশচুম্বী।

স্বাধীনতার পর থেকে বেশ কয়েক দশক অর্থনৈতিক বৈষম্য কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু আশির দশক থেকে তা আবার বাড়তে শুরু করে। ২০১৪-২০১৫ সাল এবং ২০২২-২০২৩ সালে এই বৈষম্য ঐতিহাসিকভাবে সর্বাধিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় আয়ের হিসাব, সম্পদের সমষ্টি, আয়কর, ধনীদের তালিকা, বিলিয়নিয়ারদের তালিকা, আয় ও ব্যবহার সংক্রান্ত সমীক্ষা-সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই সমীক্ষার সময় পর্যবেক্ষণ করা হইয়েছে।

২০২২-২০২৩ এর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ লক্ষ্য করলে বিষয়টি বোঝা যাবে। ওই পরিসংখ্যান বলছে, আয়ের নিরিখে একেবারে তোলার দিকে থাকা দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ একসঙ্গে যেখানে কোনও মতে দেশের গড় উপার্জনের সমান আয়ের সংস্থান করে উঠছেন ২০২২-২০২৩ সালে সেখানে সবচেয়ে ধনী ০.০০১ শতাংশ দেশবাসীর আয় ছিল গড় আয়ের ২০৬৮গুন। নিচের দিকে থাকা ৫০ শতাংশ দেশবাসীর আয় গড়ে ৭১,১৩৬ টাকা। মাঝের অংশে থাকা ৪০ শতাংশ দেশবাসীর আয় গড়ে ১,৬৫,২৭৩ টাকা। উপরের ১০ শতাংশের গড় আয় ১৩,৫২,৯৮৫ টাকা। সেখানে শীর্ষে থাকা ১ শতাংশের গড় আয় ৫৩,০০, ৫৪৯ টাকা। সর্বোচ্চ ০.১ শতাংশের গড় আয় ২, ২৪, ৫৮৪৪২ টাকা। পরিমাণটা আরও বেড়েছে সর্বোচ্চ ০০.১ এবং ০.০০১ শতাংশ ধনী নাগরিকদের ক্ষেত্রে। ২০২২-২০২৩ সালে সর্বোচ্চ ০০.১ ধনী ব্যক্তিদের গড় আয় ১০, ১৮, ১৪, ৬৬৯ টাকা এবং এবং ০.০০১ শতাংশ ধনী নাগরিকদের গড় আয় ৪৮, ৫১, ৯৬, ৮৭৫ টাকা।

সম্পদের নিরিখে বৈষম্যের কথাও তুলে ধরা হয়েছে ওই সমীক্ষায়। ২০২৩ সালের শেষের দিকে দেশের সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ধনীদের হাতে যেমন একদিকে যেমন জাতীয় সম্পদের ৪০.১ শতাংশ ছিল তেমনই- সম্পদের নিরিখে একেবারে নীচের দিকে থাকা মানুষের হাতে রয়েছে মাত্র ৬.৪ শতাংশ। গত ৬২ বছরে সম্পদের এই ফারাক সবচেয়ে বেশি। তালিকার একেবারে নিচে থাকা ৫০ শতাংশ মানুষের গড় সম্পদ ২০২২-২০২৩ সালে টাকার নিরিখে যেখানে ১৩, ৮৯,০২৯ সেখানে সবচেয়ে ধনী ০.০০১ শতাংশের হাতে থাকা গড় সম্পদ টাকার নিরিখে ২২,৬১,৩৩,৫৪,৯২৮। 

মালিকানার প্রেক্ষিতেও বৈষম্যের কথা বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে দুই দশক আগেও কিন্তু সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের হাতে জাতীয় সম্পদের ২৫.৪ শতাংশ ছিল। অন্যদিকে, নিচের দিকে থাকা ৫০ শতাংশ দেশবাসীর হাতে ছিল জাতীয় সম্পদের ৬.৯ শতাংশ।

এই তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে। একদিকে যেমন বিরোধীরা তোপ দেগেছে কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে তেমনই তাদের যুক্তি মানতে নারাজ বিজেপি। তথ্যসূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

দৈনিক সরোবর/এএস