ঢাকা, রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১

কৃষকদের দিল্লি চলো আন্দোলনে রণক্ষেত্র ভারতের শাম্ভু

সরোবর ডেস্ক 

 প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪, ০৮:১৯ রাত  

ভারতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) আইনি নিশ্চয়তা এবং অন্যান্য দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে বুধবার দফায় দফায় ফের রণক্ষেত্রের চেহারা নিল পাঞ্জাব ও হরিয়ানা রাজ্যের মধ্যবর্তী শাম্ভু সীমানা। ঘড়ি ধরে এদিন ঠিক বেলা ১১টা নাগাদ শাম্ভু সীমান্ত উত্তাল হয়ে ওঠে। সরকারি সংস্থাগুলোর আগামী পাঁচ বছর ন্যূনতম সমর্থন মূল্যে (এমএসপি) নির্দিষ্ট কয়েকটি ফসল কেনার কেন্দ্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সোমবার সন্ধ্যায় কৃষক নেতারা ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে তাদের 'দিল্লি চলো' পদযাত্রা আবার শুরু করার ডাক দিয়েছিলেন। তার আগে দু’দিন ‘অস্থায়ীভাবে স্থগিত’ ছিল ওই অভিযান। সেই কর্মসূচী মেনে শাম্ভু সীমান্তে হাজার হাজার ট্র্যাক্টর, ট্রলি, ক্রেইন নিয়ে পুলিশের ব্যারিকেড আর কড়া নিরাপত্তা বলয়ের দিকে আন্দোলনকারীরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই তাদের ছত্রভঙ্গ করতে দফায় দফায় কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটানো হয়। ড্রোনের মাধ্যমে ফেলা হয় ওই সেব শেল। মুহূর্তে ধোঁয়ায় ভরে যায় ওই এলাকা।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর থেমে যায় কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোঁড়াসহ অন্যান্য প্রতিরোধের কৌশল। এরপর কেন্দ্র সরকারের পক্ষ থেকে পঞ্চম দফা বৈঠকের আবেদন জানানো হয়। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেন, পঞ্চম দফা বৈঠকের জন্য আর্জি জানাচ্ছি। সরকার চায়, বিষয়টির শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাধান হোক। তৎকালীন এবং দীর্ঘমেয়াদী, দুই দিক থেকেই যেন একটা সমাধান পাওয়া যায় এটাই আমরা চাই।

এই আন্দোলনে কৃষকদের মূল দাবিগুলো হল ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা (এমএসপি), কৃষি ঋণ মকুব এবং স্বামীনাথন কমিশনের সমস্ত সুপারিশ বাস্তবায়ন, পুলিশ মামলা প্রত্যাহার এবং লখিমপুর খেরি সহিংসতার শিকারদের জন্য ন্যায় বিচারের জন্য আইনি গ্যারান্টি ইত্যাদি।

একই সঙ্গে জানানো হয়েছিল চতুর্থ দফা বৈঠকে যে কয়টি শস্য কেনার কথা বলা হয়েছিল তার পরিবর্তে সব কটি শস্যকে তার আওতায় আনতে হবে। এমএসপিকে আইনিভাবেও নিশ্চিত করতে হবে।

সেই বিষয়গুলির উল্লেখ করে বুধবার কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা বলেন,এমএসপি, শস্যের বৈচিত্র, এফআইআর (কৃষকদের বিরুদ্ধে যে মামলা রয়েছে)-সহ সমস্ত বিষয়ে আমরা কথা বলতে প্রস্তুত। শান্তিপূর্ণ ভাবে আলাপ আলোচনা হোক। সরকারের পক্ষ থেকে বৈঠকের কথা জানানো হলে কিছুক্ষণের জন্য ছবি বদলে যায় শাম্ভু সীমান্তে।

পাঞ্জাব কিষান মজদুর সংগঠনের নেতা সরওয়ান সিং পান্ধের বলেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।

কৃষক নেতারা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনায় বসেন। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে পরিস্থিতির বদল হয় আবারও। আন্দোলনকারীদের মধ্যে একাংশ এগোনোর চেষ্টা করলেই তাদের উপর আবার কাঁদানে গ্যাসের সেল ছোঁড়া হয়। আবারও রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় শাম্ভু সীমানা। দিল্লি চলো: এর আগে চণ্ডীগড়ে রবিবার রাতে চতুর্থ দফায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা, কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পীয়ূষ গোয়েল, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই প্রমুখ। কৃষক নেতাদের সাথে চতুর্থ দফা আলোচনায় কেন্দ্র সরকারের তরফে জানানো হয়েছিল পাঁচ বছরের জন্য এমএসপিতে ডাল, ভুট্টা এবং তুলা কিনবে সরকার। কৃষক নেতারা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এটা কৃষকদের পক্ষে নয়। একই সঙ্গে তারা এমএসপিকে আইনি নিশ্চয়তা দেওয়ার দাবিতে অনড় থাকেন।

বুধবার সকালে ‘দিল্লি চলো’ অভিযান শুরুর আগে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে পাঞ্জাব কিষান মজদুর সংগঠনের নেতা সরওয়ান সিং পান্ধের বলেন, প্রতিটি বিষয়ে আমাদের বৈঠক হয়ে গিয়েছে। এখন কেন্দ্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে, আমরা যা দেখেছি তা থেকে বলা যায়, সরকার আজ আধা সেনা দ্বারা কৃষক ও মজদুরদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলবে। দায়িত্ব তো ওদেরও (কেন্দ্রের)। প্রধানমন্ত্রী তো সবারই। তিনি সামনে এসে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন।

পান্ধের জানিয়েছিলেন, কৃষক সংগঠন শান্তিপূর্ণ ভাবে দিল্লি অভিযান চালাতে চায়। তারা চান না এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হোক যাতে কৃষকরা নিজেদের ‘ধৈর্য’ হারায়। ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট জগজিৎ সিং ঢালিওয়াল বলেন, আমরা অশান্তি সৃষ্টি করতে চাই না। কৃষকরা দিনরাত পরিশ্রম করে, তাদের রুখতে বড় বড় ব্যারিকেড দেওয়া ঠিক নয়।

শাম্ভু সীমান্ত যে সময় পুলিশ ও কৃষকের সংঘর্ষে উত্তাল হয়ে উঠেছিল, সেই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে পঞ্চম দফা ‘আলাপ আলোচনার’ কথা জানানো হয়। আবেদন জানানো হয় কৃষক সংগঠনের নেতাদের বৈঠকে বসুক। এদিকে, কেন্দ্র সরকারের সেই সিদ্ধান্তের কথা সীমান্তে মোতায়েন পুলিশ বারবার ঘোষণা করতে থাকে। এরপর এক সময় কিছুক্ষণের জন্য শাম্ভু সীমান্তে থেমে যায় সংঘর্ষ। কৃষক নেতারা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে সরকারের আবেদনের উপর আলোচনা করেন।

কৃষক নেতা সরওয়ান সিং পান্ধের বলেন, সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে কোনও কৃষক, যুবক এগোবে না। নেতারা এগিয়ে যাবেন। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে যাব। নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন বাহিনীর উপর আমরা কিছুতেই আক্রমণ করব না। ওরা (সেনা বাহিনী) আমাদের (দেশের) অংশ। আমরা খালি হাতে এগোব। কিন্তু পরিস্থিতি ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আবার বদলায় শাম্ভু সীমান্তে।

প্রস্তুত দু’পক্ষই: পরিস্থিতি যে গুরুতর হয়ে উঠতে পারে সে বিষয়ে আন্দাজ করেছিলেন অনেকেই। একদিকে আন্দোলনের নবম দিনে দাঁড়িয়ে একথা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা যে তারা কোনও মতেই পিছু হটবেন না। একই সঙ্গে সামগ্রিক সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে বুধবার যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকে সে বিষয়টা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট ছিল প্রশাসন।

‘দিল্লি অভিযান’ শুরুর আগে বুধবার সকালে কৃষক নেতা সরওয়ান সিং পান্ধের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের অনুরোধ ব্যারিকেড তুলে নিয়ে আমাদের যেন এগোনোর অনুমতি দেওয়া হয়। আমাদের রুখতে যাদের মোতায়েন করা হয়েছে সেই জওয়ানেরা আমাদের দেশের আর তাদের মুখোমুখি কৃষকরাও তো একই পরিবারের অংশ। আমরা চাই না দেশ আজ কোনও দুঃখজনক পরিস্থিতি দেখুক। আমরা বল প্রয়োগ করব না।

প্রশাসনের কড়া প্রতিরোধের মোকাবিলা করতে তৈরি ছিলেন আন্দোলনকারীরাও। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে আন্দোলনে সামিল হওয়া কৃষকেরা ইতিমধ্যে নিজেদের ‘রণকৌশল’ বদলে ফেলেছিলেন।

প্রসঙ্গত, পাঞ্জাবে ক্ষমতায় রয়েছে আম আদমি পার্টি। হরিয়ানায় বিজেপি সরকারের পুলিশের কড়া দমন নীতি ও ড্রোনের ব্যবহারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল পাঞ্জাব সরকার। অন্য দিকে, শাম্ভু, গাজিপুর, টিকরিসহ বিভিন্ন সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছিল বিশাল পুলিশ বাহিনী, র‌্যাফ ও অ্যান্টি রায়ট ভেহিকেল। কংক্রিট, লোহা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল ব্যারিকেড। বহুস্তরীয় নিরাপত্তা ঘেরাটোপ তৈরি করতে কংক্রিটের ব্যারিকেডের উপর কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছিল। রাখা হয়েছিল বিশালায়তনের কন্টেনার।

পুলিশের ডেপুটি কমিশনার জিমি চিরাম সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্তে আধাসামরিক কর্মীদের পাশাপাশি পর্যাপ্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। নিরাপত্তা কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কোনও একজন বিক্ষোভকারীকেও বা একটি গাড়িকেও দিল্লিতে প্রবেশ করতে না দিতে। মক সিকিউরিটি ড্রিল পরিচালনা করা হয়েছিল। দিল্লি পুলিশ ইতিমধ্যেই ৩০ হাজার টিয়ার গ্যাসের শেল মজুত করেছে।

ইস্টার্ন রেঞ্জের অতিরিক্ত সিপি সাগর সিং কালসি বলেছেন, আমরা গাজিপুর সীমান্তে রয়েছি। আমরা উত্তরপ্রদেশে দিল্লি সংলগ্ন জেলা গাজিয়াবাদ ও নয়ডায় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। গাজিপুরে আসা কৃষকদের সম্পর্কে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য আপাতত নেই। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হল এলাকায় শান্তি বজায় রাখা। ‘এটা সরকারের বিলম্ব নীতি’: কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত বলেন, শুরু থেকেই আমাদের দাবি তো স্পষ্ট। যার মধ্যে একটা হল এমএসপির আইনি নিশ্চয়তা। সেটা মানতে অসুবিধা কোথায়?

অন্যদিকে কৃষক নেতা জগজিৎ সিং ঢাল্লিওয়াল বলেছেন, আমরা দিল্লি যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম অনেক আগেই। গত ৭ নভেম্বর আমরা জানিয়েছিলাম যে আমরা দিল্লি যাব। তাই আজ যদি সরকার বলে হাতে সময় কম, তাহলে এটা তাদের বিলম্বের নীতি।

অন্যদিকে, দাবিদাওয়া না মানা পর্যন্ত আন্দোলন যে থামবে না সে বিষয়টা স্পষ্ট করেছেন কৃষক নেতারা। কিষাণ নেতা রাকেশ টিকায়েত বলেন, সরকারের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে সম্মিলিত ভাবে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সেটাই মেনে চলবে কৃষক সংগঠনগুলি। তবে তাদের যেভাবে রাস্তায় পেরেক পুঁতে প্রতিরোধ করছে সরকার, গ্রামে ভোট চাইতে এলে একই ভাবে নেতারাও বাধা পাবেন সে কথা তিনি আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন।

বিরোধীরা কি বলছেন?: আম আদমি পার্টি (আপ) যে কৃষকদের ‘পক্ষে’ সে কথা প্রথমদিনই স্পষ্ট করেছিলেন দলের নেতারা। প্রসঙ্গত, দিল্লি ও পাঞ্জাবে আপ সরকার ক্ষমতায় রয়েছে আর মাঝে হরিয়ানাতে ক্ষমতায় আছে বিজেপি। এদিন আপ নেতা গোপাল রাই বলেন, প্রতিটি সংগঠনের দেশে গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিবাদের অধিকার রয়েছে। দুই বছর আগে, কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে কৃষকদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে এটি এমএসপি নিয়ে একটি আইন আনবে। এ বিষয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হলেও কোনো কাজ হয়নি। এই সংসদের শেষ অধিবেশনও শেষ হয়েছে কিন্তু সরকার কিছু করেনি যার ফলে কৃষকরা তাদের বিক্ষোভ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আগামী লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতায় এলে এমএসপিকে আইনি নিশ্চয়তা দেওয়ার ঘোষণা আগেই করেছিলেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে। এদিন তিনি বলেন, আমরা তাদের (কৃষকদের) সমর্থন করছি। আমরা প্রকাশ্যে বলছি যে তাদের যুক্তিসঙ্গত দাবিগুলি পূরণ করা উচিত। আমরা আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে একে আইনি গ্যারান্টি দেওয়ার কথা উল্লেখ করব। সমস্ত ফসল এর আওতায় আনা যাবে না তবে প্রয়োজনীয় ফসলগুলি অবশ্যই থাকবে। তথ্যসূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

দৈনিক সরোবর/এএস