ঢাকা, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১

প্রাণঘাতী খেলায় মেতেছেন শি জিনপিং

সরোবর ডেস্ক 

 প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২৪, ০৮:৫২ রাত  

মিয়ানমারের জান্তা সরকার এখন মার খেয়ে যাচ্ছে বেসামরিক প্রতিরোধ গোষ্ঠীর কাছে। এই প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো জনগণের প্রতিরক্ষা বাহিনী হিসেবে পরিচিত। জাতিগত সংখ্যালঘু এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরেই বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনের বৈষম্যের বিরোধী। জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বড় আকারের আক্রমণ গত বছরের অক্টোবরে শুরু হয়। ফলশ্রুতিতে জান্তা সেনাদের বড় অংশ আত্মসমর্পণ এবং দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়। আর মিয়ানমারের বিভিন্ন অংশ দখলে নিয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সংগঠন ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স। সামরিক অভ্যুত্থান ও স্বৈরাচারী শাসন খুব কম ক্ষেত্রেই মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কোনো সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের সঙ্গেই কি মিয়ানমারের তুলনা চলে? ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জান্তা সরকারের ক্ষমতা দখলের ঘটনা দেশটির জনসাধারণের ভাগ্যে যে দুর্দশা নিয়ে এসেছে তার চেয়ে বেশি বিপর্যয়ের নজির সচরাচর দেখা যায় না। নিছকই মূর্খতা ও অপরাধমূলক কাজের কারণে জান্তাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং এবং তার সহযোগীরা এখন অনেকটাই কোণঠাসা।

এসব ধাক্কা সেনাবাহিনীর আত্মবিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিয়েছে; মনোবলও এখন কম। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের সমালোচনা হচ্ছে প্রকাশ্যে। তারপরও জেনারেলরা হাল ছাড়ছেন না। পশ্চিমাদের দেওয়া নতুন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে জান্তা সরকার গত সপ্তাহে আবারও জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়িয়েছে। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলোতে এসেছে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর জান্তার নির্বিচারে বিমান এবং স্থল হামলা বৃদ্ধির কথা। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধের একটি দীর্ঘ তালিকাও নথিভুক্ত হয়েছে।

জাতিসংঘ ধারণা করছে যে, মিয়ানমারের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষই এখন সহিংসতার। প্রায় ২৬ লাখ মানুষ দেশের ভেতরেই বাস্তুচ্যুত হয়েছে। নিহতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার, বন্দী প্রায় ২০ হাজার। মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, প্রায় ১ কোটি ৮৬ লাখ মানুষের এখন মানবিক সহায়তার প্রয়োজন— যা ২০২০ সালের থেকে ১৯ গুণ বেশি। জাতিগত নির্মূলের শিকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের ছাড়াই প্রকাশ করা হয়েছে এই পরিসংখ্যান। ২০১৭ সালে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যা ও ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের গ্রাম। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো অত্যাচারকে গণহত্যা বলে অভিহিত করেছে। মিয়ানমারের মানুষের সীমাহীন যন্ত্রণা জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশাল ব্যর্থতাকেই প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো এই ইস্যুতে যথেষ্ট ভূমিকা পালন না করার জন্য সমালোচিত হতে পারে। সুবিধা সীমিত বলেই হয়তো এখানে নামকাওয়াস্তে ভূমিকা রেখেছে পশ্চিমারা। কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনসের (আসিয়ান) অক্ষমতা বা ইচ্ছার অভাব আরও লজ্জাজনক। আঞ্চলিক সংগঠনটির কিছু সদস্য রাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে জান্তা সরকারের সঙ্গেও যোগসাজশ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এই সবকিছুর মধ্যে চীনের নেওয়া স্বার্থবাদী অবস্থান আশ্চর্যজনক না হলেও অত্যন্ত হতাশাজনক। আইন ও ন্যায়বিচারের চেয়ে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে চীন। কখনো সরকারকে সমর্থন দেওয়া, আবার কখনো জাতিগত বিদ্রোহীদের পাশে থাকা—দীর্ঘ সময় ধরে মিয়ানমারে দ্বৈত আচরণ করে আসছে বেইজিং। বর্তমানে এই অঞ্চলে চীনের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে আছে- তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বিনিয়োগ রক্ষা করা, আন্তসীমান্ত অপরাধ দমন এবং যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো।

অবশ্য চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এই পদ্ধতি তার জন্য মোটেও নতুন কিছু নয়। অন্যান্য দেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার জন্য পশ্চিমাদের উদ্দেশে তিনি প্রায়ই বক্তৃতা দেন। তবুও মিয়ানমারে চীন এবং তার ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়ার প্রভাব অনেক বেশি। অনেকাংশেই স্বার্থপর বেশ কিছু বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য পূরণ করতে অস্ত্র সরবরাহে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই দুই দেশ নিয়মিতই মিয়ানমারের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে আসছে। নেতৃস্থানীয় আঞ্চলিক শক্তি এবং বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের যে দায়িত্ব রয়েছে তার স্পষ্ট বিরোধিতা করে এই ধরনের ভণ্ডামিপূর্ণ আচরণ।

একই ধরনের পরিস্থিতি উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। এই ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের’ ওপরও চীন যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। বেইজিং হলো-উত্তর কোরিয়ার ‘স্বৈরশাসক’ কিম জং-উনের প্রধান কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক মিত্র, তার প্রধান বাণিজ্য অংশীদার এবং সবচেয়ে বড় খাদ্য সরবরাহকারী। চীনের সহায়তা ছাড়া কিম তার শাসন চালিয়ে যেতে পারতেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কিম তার পরমাণু অস্ত্র-সম্পর্কিত ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার বেপরোয়া প্রচারণা বাড়িয়েই চলেছেন। গত সপ্তাহেই ঘটেছে এর সর্বশেষ ঘটনা। এ অবস্থায় সি কেন পেছনে বসে চুপচাপ এই অস্থিরতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন? 

পশ্চিমা বিশ্লেষকদের ধারণা, শি জিনপিং বসে বসে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার অস্বস্তি উপভোগ করছেন। কিমের এসব বিদ্বেষপূর্ণ কার্যকলাপের আরেকটি কারণ হতে পারে তাইওয়ানের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া।

বৃহৎ অর্থে দেখলে, চীন এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভয়ানক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার পুরো মানবজাতির অস্তিত্বের জন্যই হুমকি। যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ এবং তার প্রতিবেশীদের ওপর বোমা হামলা করার যে হুমকি দিয়েছেন কিম, তা বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। চীন নিজেও এসবের দায় এড়াতে পারে না। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থেকে অপরিমেয়ভাবে উপকৃত হওয়া চীনকে এখন তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারণ, ক্ষমতার হাত ধরেই আসে দায়িত্ব।

দৈনিক সরোবর/এএস