শিক্ষকদের অপমানের সমাধানে সবাই এগিয়ে আসুন
সম্পাদকের কলম
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২৪, ১১:২৮ দুপুর
বাংলাদেশে দখল, কান ধরে ওঠবস করানো, জুতার মালা পরানো, আইন বর্হিভুতভাবে পদত্যাগ ও বহিষ্কার, হেনস্তা বা অপমানের সংস্কৃতি এক ধরনের চর্চা বা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে৷ রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নেতিবাচক ঘটনাগুলোর বাড়বাড়ন্ত বা পৌনঃপুনিক দৃশ্যমানতার একটি সহজাত সংস্কৃতি আছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে এ ধরনের ঘটনা যেন উৎসবে রূপ নিয়েছে৷ অনেকেই একে ‘মব জাস্টিস' বলে ঘটনার কার্য-কারণ সম্পর্ককে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছে৷ অতীতে এসব ঘটনাকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্ম চাদরে ঢাকার চেষ্টা করা হতো৷ এ দেশে ১৯৯০ সালের নির্বাচনের পর থেকে পাঁচবার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে৷ কখনো নির্বাচনের মাধ্যমে আবার কখনো রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্দোলনের মাধ্যমে৷ ক্ষমতার পালাবদলের প্রত্যেকটি ঘটনায় একটি দৃশ্য খুব সাধারণ৷ তা হলো সরকার পরিবর্তনের পর পরই নতুন দখলদারদের আবির্ভাব ঘটে৷ লুটতরাজ, দখল, অগ্নিসংযোগ ক্ষমতাচ্যুতদের ভাগ্যের সহজাত পরিণতি৷ এবারও এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি৷ রাতারাতি পদত্যাগ করানো, জোর করে অফিস থেকে বের করে দেওয়া, মারধর, হুমকি, পছন্দের ব্যক্তিদের পছন্দসই পদে বসানো ইত্যকার নৈরাজ্যকর ঘটনার কোনোটিই ঘটতে আর বাকি নেই৷ তবে অতীতের সব ঘটনাকে ছাপিয়ে গেছে শিক্ষকদের হেনস্তা ও অপমানের ঘটনাগুলো৷
বলার অপেক্ষা রাখে না, ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা পদত্যাগ করেছেন৷ অথচ স্কুল-কলেজে যা ঘটেছে তা সব ধরনের ভব্যতার সীমা লঙ্ঘন করে ফেলেছে৷ কোথাও শিক্ষার্থীরা আবার কোথাও বহিরাগতরা শিক্ষকদের শুধু জোর করে পদত্যাগই করায়নি, জুতার মালাও গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে৷ কোথাও কোথাও শিক্ষকরা অপমান ও মানসিক পীড়ন সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷ এতে ভুক্তভোগী শিক্ষকদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে দীর্ঘমেয়াদে ভয়ানক অবনমনের মধ্যে ফেলে দিয়েছে৷ শিক্ষকদের লাঞ্ছনা ও হয়রানির এসব ঘটনাকে সংক্ষুব্ধ মানুষের হঠাৎ ঘটিয়ে ফেলা কিংবা বিচ্ছিন্ন কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখার সুযোগ নেই৷ উপর্যুপরি এসব ঘটনা ঘটতে থাকলেও প্রথমদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের নৈরাজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতে ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি৷ তবে দেরিতে হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এমন ঘটনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷
আমরা জানি, একই ধরনের আইনবিবর্জিত ও অনৈতিক কাজ যদি বারবার হতে থাকে, তাহলে এর একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকে৷ তা হলো জনগণ ও সমাজের কাছে বিষয়টি সহনীয় হয়ে যায়, তা নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামায় না৷ বর্তমান ধারা বজায় থাকলে এর সুদূরপ্রসারী পরিণাম থাকবে ভয়াবহ৷ তখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দালান-কোটা থাকবে, শিক্ষক নামের কিছু কর্মচারীও থাকবে, বিদ্যাও থাকবে; কিন্তু শিক্ষা থাকবে না৷ শিক্ষকদের অপমানের এই পাইকারি বাজার রাষ্ট্রীয়ভাবে ঠেকানোর যথাযথ উদ্যোগ না নিলে শুভত্ব আর বিবেচনাবোধ বলে সমাজে কিছু থাকবে না৷ বর্তমানে যা ঘটছে তা আমাদের মানসিক অন্ধকার ও লজ্জাহীনতাকে ফুটিয়ে তুলছে৷ আমাদের প্রত্যাশা, শিক্ষকদের চলমান অপমানের সমাধানে সরকারসহ সমাজের সবাই আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসবে৷