ঢাকা, শনিবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩০

দেশের অর্থনীতিধস ডিজিটাল হুন্ডিতে 

এএসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২৩, ০৭:২৩ বিকাল  

বাংলাদেশের অর্থনীতি সর্বগ্রাসী হুন্ডির কবলে পড়েছে। শত চেষ্টা করেও এই অর্থনীতিখেকো হুন্ডির গায়ে না লাগানো যায় বিষাক্ত তীর, না লাগানো যায় বন্ধুকের গুলি। অনবরত গিলছে তো গিলছেই। 
এতে সংশ্লিষ্টরা তৎপর হয়েও কোনো কিছু করতে পারছে না। কারণ এর ভিত বড় শক্ত ও শিকড় বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত। দীর্ঘদিন ধরেই সংঘবদ্ধ চক্রগুলো অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে দেশের অর্থ পাচার করে চলেছে।

জানা গেছে, হুন্ডির প্রসার এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই- যা কখনোই বন্ধ থাকেনি। সেই হুন্ডি এখন অনেক বেড়েছে। অর্থ পাচার বেড়েছে বলেই হুন্ডির চাহিদাও এখন বেশি। খোলাবাজারে ডলারের দর এখন বেশি বলেই যে কেবল প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স হুন্ডির মাধ্যমে আসছে তা নয়। বরং অর্থ পাচার বাড়ছে বলেই হুন্ডিও বেড়েছে। তবে যারা ধনী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত, তারা অর্থ পাচার করে মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে। আর যারা ঘুষ-দুর্নীতি, কর ফাঁকি, চোরাচালান বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জন করেছেন; তারা অর্থ পাচারের জন্য বেছে নেন হুন্ডিকেই। ফলে ডিজিটাল হুন্ডির কবলে পড়ে বৈধ পথে কমছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। হুন্ডি কারবারিরা এ জন্য মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্ল্যাটফর্মকে বেছে নিয়েছে। কিছু অসাধু এজেন্ট এ অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এতে প্রবাসে বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ কমে গেছে। বিএফআইইউর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এরই মধ্যে কয়েকটি এমএফএস প্রতিষ্ঠান ৫ হাজার ৪১৯ এজেন্টশিপ বাতিল করেছে। অন্যদিকে অবৈধ গেমিং, বেটিং বা জুয়া এবং অনলাইনে বৈদেশিক মুদ্রার বাণিজ্যের মাধ্যমে পাচার হচ্ছে নগদ ডলার। বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক বিশেষ অনুসন্ধানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। আর এ ব্যাপারে বিস্তারিত তদন্তে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

বিএফআইইউ জানতে পেরেছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে বিকাশ, নগদসহ বিভিন্ন এমএফএস প্রতিষ্ঠানের নামে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করছে একটি চক্র। হুন্ডি চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশি এজেন্টের কাছে অ্যাপ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবাসীদের সুবিধাভোগীর এমএফএস অ্যাকাউন্ট নম্বর ও টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে এসএমএস পাঠাচ্ছে। এখানকার এজেন্ট সুবিধাভোগীর নম্বরে ক্যাশ ইন করে দিচ্ছে। এতে করে প্রবাসীদের অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে আসছে না।

অবৈধ গেমিং, বেটিং বা জুয়া এবং অনলাইনে বৈদেশিক মুদ্রা বাণিজ্যের মাধ্যমে পাচার হচ্ছে নগদ ডলার

জানতে চাইলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ইকোনমিকস ক্রাইম স্কয়াডের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, বিএফআইইউ থেকে একটি প্রতিবেদন তারা পেয়েছেন। প্রতিবেদন পাওয়ার আগেই তারা ডিজিটাল হুন্ডি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। এখন তাদের সুবিধা হলো। সন্দেহজনক এজেন্টের বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধানের আলোকে তথ্য-প্রমাণ পেলে মামলা দায়েরসহ আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনলাইন গেমিং, বেটিং, ক্রিপ্টোট্রেডিং বা অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে এমএফএস এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় কিছু অসাধু এমএফএস এজেন্টের কাছে এসে ক্যাশ আউট করে খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে ওইসব অনলাইন সাইটের পরিচালনাকারীদের কাছে পাচার হচ্ছে। এ ধরনের বেশিরভাগ সাইট ভারত ও চীন থেকে পরিচালিত হচ্ছে।

বেশ কিছুদিন ধরে দেশে ডলারের সংকট চলছে। এর অন্যতম কারণ রেমিট্যান্স কমে যাওয়া। ব্যাংকের পাশাপাশি খোলাবাজারেও ডলারের দর অনেক বেড়ে গেছে। চলতি বছরের শুরুর দিকেও খোলাবাজারে প্রতি ডলার ৯৮ টাকার আশপাশে ছিল। সম্প্রতি যা সর্বোচ্চ ১১৯ টাকায় উঠেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনসহ বিভিন্ন উদ্যোগের পর দর এখন কিছুটা কমে ১০৮ থেকে ১১৪ টাকায় নেমেছে। আবার আমদানি পর্যায়েও ৮৬ টাকায় থাকা ডলারের দর ১১২ টাকায় উঠেছিল। এখন যা কিছুটা কমে ১০৮ থেকে ১১২ টাকায় নেমেছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়ায় ডলারের দর এভাবে বেড়েছে। এর প্রভাবে বাজারে পণ্যমূল্য বেড়েছে।

সংশ্নিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হুন্ডি চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এমএফএসের এজেন্টশিপ নিয়েছে। তাদের কাছে বিদেশ থেকে শুধু টাকার পরিমাণ ও নম্বর উল্লেখ করে নির্দেশনা আসে। সে আলোকে সুবিধাভোগীর নম্বরে এখান থেকে অর্থ পরিশোধ হয়। দ্রুততম সময়ে সুবিধাভোগীর নম্বরে টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়। সাধারণত এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সার্ভিস চার্জ নেয় না হুন্ডি কারবারিরা। ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে যেখানে গড়ে ৪ শতাংশের মতো খরচ হয়; আবার ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় দর বেশি দেওয়া হয়। হুন্ডি কারবারিদের আউটলেট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিদেশে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকার কাছে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা বাসা থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসে। কখনও কখনও প্রবাসীর পক্ষে অগ্রিম অর্থ পাঠিয়ে দেয়। এ রকম নানা সুবিধার কারণে হুন্ডিতে ঝুঁঁকছেন অনেকে।

হুন্ডি ও অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম। জানতে চাইলে তিনি বলেন, অর্থ পাচার অনেক পুরোনো একটি সমস্যা। বর্তমানে প্রবাসী আয়ের অর্ধেকের বেশি হুন্ডিতে আসছে। সাধারণত দেশের ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ কিংবা কর ফাঁকির অর্থ পাচার হচ্ছে। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর না হলে এ প্রবণতা কমানো যাবে না। ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় হুন্ডিতে অনেক বেশি দর দেওয়া হচ্ছে। ফলে হুন্ডির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চ্যানেল পেরে উঠছে না। এতে বৈদেশিক মুদ্রা বাইরেই থেকে গিয়ে দেশের মুদ্রাবাজারে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে।